‘এলিয়েন এসেছিল ২০১৭ সালে এবং আরও আসছে’

, ফিচার

শুভ্রনীল সাগর, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম | 2023-08-22 17:56:36

সিনেমাগুলোতে যেমন দেখা যায়, বড় একটি ফ্লাইং সসারে করে মহাকাশ থেকে এলিয়েন পৃথিবীতে আসে। কিন্তু বাস্তবে যদি এলিয়েন আমাদের গ্রহে আসে তাহলে হয়তো এমনটি হবে না। সেটি হবে একটি এলিয়েন সভ্যতার জঞ্জাল!

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি’র জোতির্বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ার অধ্যাপক এভি লোয়েব’র মত এমনই। তিনি বিশ্বাস করেন, সেই আবর্জনার কিছুর অংশ তিনি খুঁজে পেয়েছেন।

চলতি বছরের আগামী ২৬ জানুয়ারি প্রকাশিতব্য তার বই ‘এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল: দ্য ফার্স্ট সাইন অব ইনটেলিজেন্ট লাইফ বেয়ন্ড আর্থ’-এ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, সৌরজগতে পাওয়া একটি বিশেষ বস্তু নিছকই উড়ে আসা কোনো পাথর খণ্ড নয় বরং সেটি এলিয়েন প্রযুক্তির একটি অংশ।

বস্তুটি ২৫ আলোকবর্ষ দূরে আমাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র ‘ভেগা’ থেকে পৃথিবীর দিকে উড়ে আসে। ২০১৭ সালের ০৬ সেপ্টেম্বর সৌরজগতের অরবিটাল প্লেনে বস্তুটি ইন্টারসেপ্টটেড অর্থাৎ বাধা পায়।

সেবছরেরই ০৯ সেপ্টেম্বর, বস্তুটির ট্র্যাজেক্টরি (ধুমকেতু, গ্রহাণু বা মহাকাশে উড়ন্ত কোনো বস্তু যে পথ ধরে যায়) তাকে সূর্যের কাছে নিয়ে আসে এবং মাসের শেষের দিকে শুক্র গ্রহের কক্ষপথ থেকে দূরে ঘণ্টায় ৫৮,৯০০ মাইল গতিতে এটি বিস্ফোরিত হয়। এরপর ০৭ অক্টোবর, পেগাসাস নক্ষত্র এবং এর বাইরে অন্ধকারের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার আগে এটি পৃথিবীকে অতিক্রম করে।

হাওয়াইয়ে স্থাপিত পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ ‘প্যানরমিক সার্ভে টেলিস্কোপ অ্যান্ড র‌্যাপিড রেসপন্স সিস্টেম (প্যান-এসটিআরআরএস)’-এ সর্বপ্রথম এটি ধরা পড়ে। প্রাথমিকভাবে মহাকাশের এই বস্তুটির ছদ্মনাম দেওয়া হয় ওহমুআহমুআহ (Oumuamua)। হাওয়াই শব্দ Oumuamua’র (উচ্চারণ ওহমুআহমুআহ) ইংরেজি অর্থ ‘স্কাউট’।

ওহমুআহমুআহ লম্বায় প্রায় ৩০০ ফুট। মহাকাশে এর চেয়েও অনেক বড় বড় বস্তুদের ওড়াউড়ি চলতেই থাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি বিশেষ একটি বস্তু। কারণ, আমাদের সৌরমণ্ডলে এটি প্রথম কোনো সৌরজগত বহির্ভূত বস্তু (ইন্টারস্টেলার অবজেক্ট)। জোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, এটি সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা আবদ্ধ ছিল না। এর মানে, এটি ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই এসেছিল।

ওহমুআহমুআহ’র কোনো ছবি তোলা যায়নি কিন্তু জোতির্বিজ্ঞানীরা প্যান-এসটিআরআরএস অভজারভেটরি টেলিস্কোপ দিয়ে দিস্তা দিস্তা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। প্রথম দিকে, বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, এটি সাধারণ কোনো ধূমকেতু বা গ্রহাণু। কিন্তু পরে তাদের ধারণা পাল্টে যায়।

অধ্যাপক লোয়েব এটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, কেমন হবে যদি আদিম কোনো গুহাবাসী একটি স্মার্টফোন দেখে? সারাজীবন সে পাথর দেখে অভ্যস্ত তাই স্মার্টফোন হাতে নিয়ে সে হয়তো ভাববে, এটি চকচকে কোনো পাথর। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।

এটি কোনো ধূমকেতু ছিল না। এটি ছিল এলিয়েন সভ্যতা থেকে আসা কোনো বাতিল প্রযুক্তি, যোগ করেন তিনি।

বেশ কয়েকটি অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য লোয়েবকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এর মধ্যে প্রথম, ওহমুআহমুআহ’র মাত্রা বা ডাইমেনশান। বস্তটি কিভাবে সূর্যের আলোতে প্রতিফলিত হয় সেটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এর উজ্জ্বলতা প্রতি আট ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। এর মানে, পুরো ঘূর্ণন বা আবর্তন (রোটেশান) সম্পূর্ণ করতে এটি এই পরিমাণ সময় নেয়।

নীল বৃত্তে প্রথম কোনো সৌরজগত বহির্ভূত বস্তু ও হমুআহমুআহ’র সমন্বিত ছবি (Photo: ESO/K. Meech)

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওহমুআহমুআহ অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল। এটি সাধারণ কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি প্রতিক্ষেপক বা প্রতিফলনকারী। এর পৃষ্ঠভাগ কোনো উজ্জ্বল ধাতু দিয়ে তৈরি।

ওহমুআহমুআহ’র সরণও (বস্তুর এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়া) বেশ বিস্ময়কর। যেভাবে এটি সূর্য থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলেছে (যেমনটি নভোযানগুলো করে থাকে) তা বিজ্ঞানীদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে।

পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা সূর্যকেন্দ্রিক মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে মহাকাশের কোনো বস্তুর কোন পথে ও কত গতিতে সরণ হবে তা নির্ণয় করতে পারেন। এক্ষেত্রে বস্তুটি যত সূর্যের কাছে যাবে তত বেশি গতিতে নিজের দিকে টানতে থাকবে। কিন্তু ওহমুআহমুআহ পদার্থবিজ্ঞানের সরণসূত্র ও নির্ণিত ট্র্যাজেক্টরি অনুসরণ করেনি। এর মানে, সূর্যের মহাকর্ষীয় বল ছাড়াও অন্যকোনো উচ্চ গতি বস্তুটিকে অন্যদিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

সহজে বললে, গ্রহাণুগুলো সাধারণত একই ত্বরণে উড়ে যায়। সূর্যকে অতিক্রমকালে এদের পৃষ্ঠভাগ উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেজের দিক থেকে একবার হিমায়িত গ্যাস নির্গত হয়। রকেট ইঞ্জিন এভাবেই কাজ করে।

বিজ্ঞানীরা খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন, ওহমুআহমুআহ এমন কোনো হিমায়িত গ্যাস বা ধুলো নির্গমন করেনি। এমনকি অন্যকিছু নির্গমনের কোনো চিহ্নও পাননি।

লোয়েবও নিশ্চিত, এটি কোনোভাবেই সাধারণ কোনো গ্রহাণু বা বস্তু নয়। এসব তথ্য-উপাত্তই তাকে বিশ্বাস যোগাচ্ছে, ওহমুআহমুআহ এলিয়েন সভ্যতারই কোনো প্রযুক্তির যন্ত্রাংশ।

বস্তুটি আসলে কী?

যথেষ্ট অদ্ভুত শোনালেও একটি সম্ভাবনা, পৃথিবীরই কোনো প্রযুক্তিতে এটি মিলতে পারে। প্রায় ৪শ বছর আগে, জোতির্বিদ জোহাননেস কেপলার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, গ্রহাণুদের লেজ থেকে নির্গত গ্যাস তাদেরকে বাড়তি গতি এনে দেয়। ঠিক এটিই তিনি নভোযান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভেবেছিলেন।

বলাই বাহুল্য, তার বৈজ্ঞানিক ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে লাইট-সেইল বানাতেও একই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন তারা। লাইট-সেইল হলো, খুবই কম ওজনের ভাঁজ করে ফেলা যায় এমন উচ্চ প্রতিফলন ক্ষমতা সম্পন্ন পর্দা যা সূর্য থেকে আসা কণাগুলো (পার্টিকল) ধারণ করতে সক্ষম এবং শূন্যগর্ভের মধ্য দিয়ে নভোযানকে উচ্চগতি সরবরাহ করতে পারে। অন্যদিকে, পৃথিবী থেকে লাইট-সেইলে পাঠানো শক্তিশালী লেজারের মাধ্যমে এই গতি আরও বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব।

শিল্পীর আঁকা ওহমুআহমুআহ’র সম্ভাব্য আকার (Photo: Mark Garlick/Science Photo Library)

অধ্যাপক লোয়েব পরীক্ষামূলকভাবে পার্শ্ববর্তী নক্ষত্রে লাইট-সেইলচালিত ছোট নভোযান পাঠানোর একটি প্রকল্পে জড়িত। তিনি বলছেন, আমরা পৃথিবীবাসীরা যদি এমন ভাবনা (লাইট-সেইল প্রযুক্তি) ভাবতে পারি তাহলে এলিয়েনরা নয় কেন?

তিনি আর তার সহকর্মীর ধারণা, ওহমুআহমুআহ আসলে এরকমই লাইট-সেইল প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে যা তাকে অস্বাভাবিক ত্বরণে সূর্যকে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।

বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত পদ্ধতির কারণে লোয়েব শতভাগ নিশ্চিত হতে না পারলেও তার জোর বিশ্বাস, বস্তুটি এলিয়েন সভ্যতার কোনো যন্ত্রাংশ।

এলিয়েন সভ্যতা খোঁজের একমাত্র উপায় হলো তাদের জঞ্জালগুলোর খোঁজ করা। যেমন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা ‘ট্র্যাশ’ ধরে ধরে মূল প্রতিবেদনে এগোন, বলছেন লোয়েব।

বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের অনেকেই তার এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস সায়েন্স ইনস্টিটিউট ‘ন্যাচার অ্যাস্ট্রোনমি’-তে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ওহমুআহমুআহকে এলিয়েনদের যন্ত্রাংশ বলার পক্ষে আমরা কোনো জবরদস্ত প্রমাণ পাইনি।

এ নিয়ে লোয়েবের বক্তব্য, পৃথিবীর বাইরেও যে ভিন্ন সভ্যতা রয়েছে এই সম্ভাবনা নিয়ে কিছু মানুষ আলোচনা করতে চায় না। তারা মনে করে, একমাত্র তারাই বিশেষ ও অনন্য। আমার মনে হয়, আমাদের এই গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর