করোনা ও শীতের সন্ধিক্ষণ

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 02:55:11

বঙ্গাব্দ ১৪২৭ মোতাবেক ২০২১ সালের মাঘ মাস যথারীতি শুরু হয়েছে ‘মাঘের বাঘ পালানো’ শীত নিয়ে। শুধু তাই নয়, সার্বিক পরিস্থিতিকে বলা যেতে পারে করোনা ও শীতের সন্ধিক্ষণ। কারণ, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা অনুযায়ী, শীতে করোনার প্রকোপ কোথাও কোথাও বেড়েছে।

আবহাওয়া বুলেটিনে আরো শৈত্য প্রবাহের পূর্বাভাস রয়েছে মাঘ মাসে। শীত ঋতুর শেষ মাসটি বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুনের শরীরে ঢলে পড়ার আগে অবধারিতভাবে শীতের শেষ কামড়ও হানবে। আর সঙ্গে থাকবে করোনার ভয়ও।

দক্ষিণ গোলার্ধের বাসিন্দা আমরা জানি, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে শীত আরো প্রবলতর বেগে জেঁকে বসেছে। কোথাও জমেছে বরফের আস্তরণ। তাপমাত্রা নেমে গেছে মাইনাসে। সেসব দেশে জনজীবন প্রায়-স্তব্ধ তীব্র শীতের প্রভাবে এবং ক্রমবর্ধমান করোনার প্রকোপে।

গত বছরের (২০২০ সাল বা ১৪২৬ বঙ্গাব্দ) শীতের শেষে বিশ্বময় যে করোনা মহামারির উদ্ভব হয়েছিল, উত্থান-পতনের মধ্যে তা এখনো বহাল। আমেরিকা চরমভাবে আক্রান্ত। ইউরোপে দেখা মিলেছে করোনার আরো মারাত্মক 'একটি ধরন'। কানাডার কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে চলছে ইমার্জেন্সি। বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ। ফ্রান্সে জারি করা হয়েছে কারফিউ। ব্রিটেনে চলছে প্রলম্বিত লকডাউন।

করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের কোনো কোনো অংশে আবার প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশকে ধরে ধরে করোনা পরিস্থিতির বিবরণ দেওয়া সম্ভব। এবং শীতে যে প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা শীতপ্রধান দেশে প্রবল হলেও কম-বেশি সকল দেশেই প্রকটিত।

আশার কথা হলো, করোনার এক বছরের সার্কেল শেষ হতে না হতেই হাতে ভ্যাকসিন চলে এসেছে। অনেক দেশে ভ্যাকসিন প্রদান শুরুও হয়েছে ধাপে ধাপে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ বিশ্বের প্রায়-সকল দেশের অধিকাংশ মানুষই ভ্যাকসিনের আওতায় চলে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী।

রবীন্দ্রনাথ যেমন মাঘের মৃত্যুচিত্র অঙ্কন করেছেন কবিতায়, বিশ্ববাসী তেমনি প্রত্যাশা করছে করোনার অন্তর্ধান বা বিদায়। ‘মাঘ’ নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘পুরানো শীত পাতা-ঝরা, তারে এমন নূতন করা/মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে খেয়ে ফুলের মার গো’। শীতার্ত মাঘ মরে গিয়ে বাসন্তিক ফাগুন যেমন আসে, করোনার সঙ্কুলতা কেটে তেমনি ফিরে আসবে নীরোগ বিশ্ব। এমন আশা সকলের মনে।

যদিও করোনাকাল, তথাপি চিরায়ত বাংলার বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতিতে মাঘ মাস প্রচণ্ড উৎসবমুখর। মাঘ মাসে নানা ফসলের প্রাচুর্য এবং নানানরকম খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে যায় গ্রামবাংলায়। শীতের পিঠা তৈরি হয় এ সময় ঘরে ঘরে। মাঘেই হয় মাঘোৎসব। মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, মাছ-পাখি শিকার, বিয়েশাদির জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান, আত্মীয়র বাড়ি বেড়ানো এই মাসেই বেশি চলে।

সত্যিকারের শীত উপভোগের আর অখণ্ড অবসর উদযাপনের মাসও মাঘ। পুঁথি পাঠ, গম্ভীরা গান, যাত্রা, থিয়েটার, কবিগান ইত্যাদির আয়োজন চলে গ্রামগঞ্জে ও মফস্বলে। পানি অনেক কমে যায় বলে নদী-বিল-খাল-পুকুরে নানারকম মাছ ধরার কাজে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করেন। বাজারে পাওয়া যায় হরেক রকমের দেশীয় মাছ।

পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রা, থিয়েটার উৎসবে মেতে থাকে শহর-গ্রাম। শীতের কুয়াশা জড়ানো রহস্যময় চাদর ভেদ করে বাঙালির উৎসবের মাস হয়ে ওঠে মাঘ। প্রকৃতিও তখন কুয়াশা আর শিশিরের মায়াবী পর্দায় আবৃত করে সমস্ত চরাচর, সারা পৃথিবী।

শীতে আগুন জ্বেলে উত্তাপ পাওয়ার চেষ্টায় নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের যে চিত্র দেখা যায়, তা মূলত মাঘের। প্রত্যন্ত গ্রামে, শহরের বস্তি এলাকায় কিংবা রাতের নিঝুম রাজপথে জবুথবু মানুষের কষ্টের চিত্রটিও মাঘ মাসের ভয়ঙ্কর শীতের সময়েই স্পষ্টত দেখা যায়। উত্তরের প্রান্তিক জেলাগুলোতে শীত অনেক নেমে যায় বরফাচ্ছন্ন হিমালয়ের নৈকট্যের কারণে।

এমনই ঘোরতর শীতের মাস মাঘের শুরু হয়েছে। চলছে করোনাকালও। এরই মাঝ দিয়ে বইছে মানুষের যাপিত জীবন। জীবনের একদিকে উৎসব-উদযাপনের আঙিনা। অন্যদিকে সঙ্কুল পরিস্থিতির কালোমেঘ। দৃশ্যপটে দোলা দিচ্ছে আশা ও হতাশার বিপরীতমুখী প্রবাহ।

কিন্তু হতাশা ও ধ্বংসের অমানিশা কেটে আশাবাদী ভোর ও সৃজনের কাল আসবেই। যেমন শীত শেষে আসে বসন্ত, তেমনি আসবে নবকল্লোলিত ব্যাধিমুক্ত পৃথিবী। রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী কবিগণের অন্যতম অমিয় চক্রবর্তী ‘মাঘ সংক্রান্তির রাতে’ কবিতায় এমনটিই লিখেছেন, ‘হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে/তোমার পবিত্র অগ্নিজ্বলে/অমাময়ী নিশি যদি সৃজনের শেষ কথা হয়/আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়...।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর