করোনা ভ্যাকসিন: আগ্রহ, অনীহা ও বিভ্রান্তি

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 02:55:11

ইংল্যান্ডে সপরিবারে অবস্থানরত এক সহকর্মী জানালেন, 'আমার শাশুড়িকে ফাইজারের ভ্যাকসিন দিল, কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই।  তিনি ভ্যাকসিন দিতে চান নি। বলেছেন, আমাদের না দিয়ে ইয়ংদের দেয়া দরকার। আমরা তো অনেক দিন বেঁচে আছি।'

পরহিত-চিন্তার এমন দৃষ্টান্ত আশাপ্রদ। ইংল্যান্ডে প্রবল করোনা প্রকোপের মধ্যে বয়স ও পেশার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার অনুযায়ী জোরকদমে ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। অচিরেই বুড়ো বা যুবক নয়, সব নাগরিকই ভ্যাকসিনের আওতায় চলে আসবেন।

আমেরিকাতেও চলছে সাধারণের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম, যাতে সেদেশের অপরাপর নাগরিকদের মতো অভিবাসী বাংলাদেশীরাও রয়েছেন। আমাদের চেনাজানা মার্কিন-বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন, তাদের কারো কারো সঙ্গে কথা হয়েছে। ভ্যাকসিন গ্রহণে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়ার কথা তারা জানান নি। মামুলী ব্যাথা ও ঝিমুনি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা তাদের হয়নি।

একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া এখন পর্যন্ত করোনা ভ্যাকসিনের বিশেষ কোনো বিরূপ বা ক্ষতিকর পাশ্ব-প্রতিক্রিয়ার খবর মিডিয়ায় আসেনি। বরং মানুষ নির্ধারিত অগ্রাধিকার তালিকা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য আগ্রহ ভরে অংশগ্রহণ করছেন।

ভ্যাকসিন নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার উৎসাহব্যঞ্জক চিত্রের বিপরীত প্রতিচিত্র দেখা যাচ্ছে এশিয়ায়, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশে। গবেষণা পরিসংখ্যানে ভারতীয় মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন সম্পর্কে অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে।

ভারতের ২৬২টি জেলা থেকে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ২৫ হাজার জনের ৬০ শতাংশের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়ায় অনীহা রয়েছে। অন্য দিকে ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী ৬৭ শতাংশ আমেরিকানই কোভিড ভ্যাকসিন নিতে চান। কিন্তু সেখানেও ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্যাকসিন সম্পর্কে অবিশ্বাস রয়েছে। এই অবিশ্বাস বেশি দেখা যায় প্রান্তিক মানুষ, জনজাতি ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে।

বিশ্ববাসী যখন করোনা মোকাবেলায় ভ্যাকসিনের জন্য মুখিয়ে আছে, তখন মানুষের মধ্যে এহেন অনাগ্রহ ভাবনার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কেন মানুষের মধ্যে এই অনীহা ও অনাগ্রহ?  ভ্যাকসিন প্রদান প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো বিভ্রান্তি রয়েছে কিনা, তা-ও তলিয়ে দেখা হচ্ছে।

ভ্যাকসিন নিয়ে অনীহা, অনাগ্রহ, বিভ্রান্তি, যা-ই থাকুক না কেন, তা ভ্যাকসিন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত যাদের হাতে, তাদের কাজটা কঠিন ও জটিল করে তুলেছে। কারণ, বৈশ্বিক মহামারি দমন করার স্বার্থে সেসব মানুষের কাছেও ভ্যাকসিন পৌঁছে দিতে হবে, যাদের মধ্যে ভ্যাকসিনেশন নিয়ে রয়েছে সন্দেহ, কুসংস্কার বা বিভ্রান্তি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাংস্কৃতিক বা বিশ্বাসগত দিক থেকে যারা আধুনিক চিকিৎসা বা ভ্যাকসিনে বিশ্বাস করেন না, তাদেরকে মোটিভেশন করতে হবে। তাছাড়া, ভ্যাকসিন সম্পর্কে যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে, সেগুলোও দূর করতে হবে।

বলা হচ্ছে, মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি আসছে কয়েকটি কারণে। যথা, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা দেশ সম্পর্কে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণে, ভ্যাকসিন কেনা বা সংগ্রহের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার কারণে, নকল ভ্যাকসিন সরবরাহ হতে পারে, এমন আশঙ্কার কারণে, ভ্যাকসিন প্রয়োগের সঙ্গে জড়িতদের দক্ষতা ও সততা সম্পর্কে নিম্ন ধারণার কারণে এবং ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নৈতিক মান ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে আস্থাহীনতার কারণে।

এসব সমস্যা ও বিভ্রান্তি পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে নেই বলে সেসব দেশে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে এবং নাগরিকগণও নির্দ্বিধায় ভ্যাকসিন গ্রহণ করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনুন্নত দেশগুলোতে, যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক, ভঙ্গুর, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অস্বচ্ছ  এবং স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত পেশাগোষ্ঠী অদক্ষ ও অবিশ্বস্ত আচরণের জন্য প্রায়শই অভিযুক্ত।

বাংলাদেশে এখনো ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয় নি। ফলে এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত নানা ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যথোপযুক্ত পূর্ব-প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মানুষের জীবন-মরণ জড়িত যে ভ্যাকসিনের সঙ্গে, তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র অনীহা বা বিভ্রান্তি থাকা চরম বিপজ্জনক ও আত্মঘাতী।   

এ সম্পর্কিত আরও খবর