করোনা ভ্যাকসিন কোনটি কতোটা কার্যকারী

, ফিচার

শুভ্রনীল সাগর, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 03:12:49

গেলো ডিসেম্বরের শেষদিকে, ৮৫ বছরের কলিন হর্সম্যান শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ডনচেস্টার রয়েল ইনফার্মারি-তে ভর্তি হলেন। চিকিৎসকরা ভেবেছিলেন, এটি নিছক কিডনি সংক্রমণজনিত কোনো সমস্যা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার কোভিড-১৯ ধরা পড়লো। সমস্যা গুরুতর হলে চিকিৎসকরা তাকে ভেন্টিলেটরে রাখেন। এর কয়েকদিন পরেই মারা যান তিনি।

একদিক দিয়ে দেখলে, মহামারীকালে হর্সম্যানের এই মৃত্যু তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সারা বিশ্বে যেখানে করোনায় মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে তখন এটি নিছকই একটি সংখ্যা। কিন্তু অন্য একটি জায়গায় হর্সম্যান খুবই বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। কীভাবে?

হর্সম্যানের ছেলের বরাতে ব্রিটিশ একটি সংবাদমাধ্যম বলছে, মৃত্যুর প্রায় তিন সপ্তাহ আগে তিনি ফাইজার-বায়োএনটেক (Pfizer-BioNTech) আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ডোজ নিয়েছিলেন। সারাবিশ্বে তিনি ছিলেন ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ডোজ পাওয়া অল্প সংখ্যক ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। মৃত্যুর দুইদিন আগে তার ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার কথা ছিল।

চিকিৎসকদের মতে, অধিকাংশ ভ্যাকসিন ঠিকঠাক কাজ করতে বুস্টার’র দরকার হয়। যেমন সারাবিশ্বে শিশুদের এমএমআর (measles, mumps and rubella) ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, এই তিন প্রাণঘাতী সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে। প্রায় ৪০ শতাংশের মতো মানুষ যারা এর মাত্র একটি ডোজ নিয়েছে, তারা ওই তিন ভাইরাস থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। গবেষণা বলছে, বিশ্বে মাত্র চার শতাংশ মানুষ এমএমআর-এর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে।

বুস্টার ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে

যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) প্রথম কোনো ভ্যাকসিনের মুখোমুখি হয়, তখন এটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধরণের শ্বেত রক্ত কণিকাকে সক্রিয় করে। প্রথমটি প্লাজমা ‘বি সেল’, যা প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিবডি তৈরিতে জোর দেয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই বি সেল ক্ষণজীবী। তাই মানুষের শরীর অ্যান্টিবডিতে কার্যত সাঁতার কাটলেও দ্বিতীয় ডোজ না নিলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।

শ্বেতরক্ত কণিকার দ্বিতীয়টি হলো, টি সেল। যা খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট কোনো জীবাণু ধ্বংসের কাজ করে থাকে। এদের মধ্যে কিছু রয়েছে ‘মেমোরি টি সেল’, যারা কয়েক দশক ধরে শরীরে কাজ করে যেতে সক্ষম। শরীরভেদে এটি সারা জীবনও থাকতে পারে। কিন্তু ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ না নেওয়া অব্দি খুব বেশি মেমোরি টি সেল তৈরি হয় না। বুস্টার ডোজটি হলো অ্যান্টিজেনগুলোর সঙ্গে শরীরকে আবার পরিচিত করার একটি উপায়।

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন’র ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড্যানি আল্টম্যান বলছেন, প্রথম ডোজটি নেওয়ার পরে আপনি জীবাণুগুলোকে কেবল একটি লাথি দিলেন। কাজেই জীবাণুগুলো পুরোপুরি ধরাশায়ী হয় না। এরপর বুস্টার তথা দ্বিতীয় ডোজটি নেওয়ার পর আপনার শরীরে উচ্চতর ফ্রিকোয়েন্সির মেমোরি টি সেল এবং পাশাপাশি অসংখ্যা বি সেল তৈরি হবে। এরা উচ্চ গুণমান সম্পন্ন অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকবে।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সিঙ্গেল ডোজ কতটা কার্যকারী ?

এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কোটি টাকার প্রশ্ন এটি। বিশেষত ব্রিটিশ সরকার বর্তমানে অনুমোদিত সমস্ত কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজটি ৩/৪ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অন্যদিকে, রাশিয়া তাদের ‘স্পুটনিক লাইট’ নামের স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের সিঙ্গেল ডোজ দিয়েই ট্রায়াল চালিয়ে যাচ্ছে। যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এখন দেখে নেওয়া যাক, অনুমোদিত সব ভ্যাকসিনগুলোর কে কতোটা কার‌্যকরী।

ফাইজার-বায়োএনটেক (Pfizer-BioNTech)

গেলো বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ফাইজারের তথ্য অনুযায়ী, তাদের ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজের পর কার্যকারী হার ৫২ শতাংশ। তাদের পরীক্ষার শেষ ধাপ তথা ফেজ থ্রি ট্রায়ালে ৩৬,৫২৩ জনের শরীরে দুটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, যারা করোনা সংক্রমিত ছিলেন না। পরবর্তীতে ১২১ জনের শরীরে কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা যায়।

তথ্য আরও বলছে, এই প্রাথমিক সুরক্ষাটি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতার মধ্য দিয়ে আসে। প্রথমত, ভ্যাকসিন কমপক্ষে ১২ দিন না হলে কাজ করা শুরু করে না। দ্বিতীয়ত, একটি ডোজ এখনও দুটির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম প্রতিরক্ষামূলক। 

কিন্তু এমন খবরও অন্তর্জালজুড়ে ঘুরছে, প্রথম ডোজটিই প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যকারী । দ্বিতীয় ডোজ না নিলেও চলবে! সেটি ফেলে দেওয়ার মতোও নয়, যখন যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অন ভ্যাকসিনাজেশান অ্যান্ড ইমিউনিজেশন (জেসিভিআই) এই তথ্য দেয়। তারা ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ভিন্নভাবে হিসাব করেছেন। সংক্রমণের সংখ্যার সমস্ত ডেটা ব্যবহার করার পরিবর্তে তারা কেবল ১৫-২১ দিনের হিসাবের দিকে লক্ষ্য রাখেন।

প্রথম ডোজটি কাজ শুরু করতে যে ন্যূনতম ১২ দিন সময় নেয়, সেটিও তারা ধর্তব্যের মধ্যে রাখেননি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে, ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা লাফিয়ে ৮৯ শতাংশে চলে যায়। কিন্তু বিষয়টি এতো সহজে সিদ্ধান্তে আসার কোনো বিষয় নয়। শুধু দিনগুনে উপসর্গ দেখা ছাড়াও আরও প্রভাবশালী প্রভাবক রয়েছে যা ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

বিষয়টি আরেকটু সামনে নিলে অর্থাৎ দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সাত দিনের মধ্যে (২১-২৮ দিন) হিসাব করলে, কার্যক্ষমতা দাঁড়ায় ৯২ শতাংশ। এক পক্ষের বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সময়টিতে দ্বিতীয় ডোজ ঠিকমতো কাজ করাই শুরু করে না।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা (Oxford-AstraZeneca)

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো একটু আলাদা। চলতি জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখকের দাবি, তাদের ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটি ৬৪.১ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। একইভাবে দুটি ডোজ দেয় ৭০.৪ শতাংশ সুরক্ষা।

এদিকে, এইসব অপ্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিন কমিটির অনুমান, তিন সপ্তাহ থেকে প্রথম ইনজেকশন দেওয়ার পরে ৯-১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ভ্যাকসিন প্রায় ৭০ শতাংশ গুরুতর রোগ প্রতিরোধ করে। কারণ, তিন ধাপের পরীক্ষায় প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে ছয় ও বারো সপ্তাহের দুটি ব্যবধান রয়েছে। তবে এটি অন্তত নিশ্চিত করে বলা সম্ভব, বুস্টার ডোজের আগ পর্যন্ত প্রথম ডোজ কমপক্ষে কয়েক মাস সুরক্ষা দেবে।

মর্ডানা (Moderna)

ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশান (এফডিএ)-কে জমা দেওয়া মর্ডানা’র রিপোর্ট অনুযায়ী, তাদের ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ ৮০.২ শতাংশ এবং দুটি ডোজ ৯৫.৬ সুরক্ষা দেবে। তবে ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য এই হার ৮৬.৪ শতাংশ।

করোন্যাভ্যাক (CoronaVac)

করোনাভ্যাক বেইজিংভিত্তিক একটি বায়োফার্মাচিউটিক্যাল কোম্পানি ‘সিনোভ্যাক’র বানানো ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনটিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অস্বাভাবিক’। কারণ, এটি বেশ কয়েকটি দেশে স্বতন্ত্রভাবে পরীক্ষা করার পর ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দিয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) প্রথম করোনাভ্যাক সম্পর্কে মতামত দেয়। তাদের দাবি, এটি ৮৬ শতাংশ কার্যকারী । তুরস্কের গবেষকদের মতে, এটি ৯১.২৫ শতাংশ সুরক্ষিত। ৬৫.৩ শতাংশ কার্যকারী বলে মত ইন্দোনেশিয়ার বিজ্ঞানীদের। অন্যদিকে, ব্রাজিলের ‘বুটানট্যান ইনস্টিটিউট’ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, এটি ৫০.৪ শতাংশ সুরক্ষা দেয়।

তবে তাদের কেউই প্রথম ডোজের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো তথ্য দেয়নি। এসবই দ্বিতীয় ডোজ পরবর্তী পরিসংখ্যান।

স্পুটনিক ভি (Sputnik V)

আইকনিক সোভিয়েত যুগের প্রথম আর্টিফিশিয়াল স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক ১’ এর নামানুসারে রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিনটির নাম দিয়েছে ‘স্পুটনিক ভি’। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে পৃথিবীর কক্ষপথে স্পুটনিক ১ পাঠানো হলে তিন মাস পর ব্যাটারি শেষ হয়ে বিধ্বস্ত হয়। মস্কোতে অবস্থিত ‘গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি’ স্পুটনিকের স্মরণে ভ্যাকসিনটির নামকরণ করেছে।

রাশিয়ার দাবি, দুই ডোজের পর তাদের ভ্যাকসিনটি ৯১.৪ শতাংশ কার্যকর। যদিও এ বিষয়ে কোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধ তারা প্রকাশ করেনি।

ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ কি এড়ানো যেতে পারে?

এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব সারে’র ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডেবোরাহ ডান-ওয়াল্টারসের মত, প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলোতে দেখা গেছে, প্রথম ডোজের পর যথেষ্ট পরিমাণ ইমিউনিটি তৈরি হয়নি। দুটি ডোজের পর রক্তে বেশি পরিমাণ অ্যান্টিবডি ও টি সেল মিলেছে।

ফাইজার’র প্রধান নির্বাহী আলবার্ট বরুলা’র মতে, এটা হবে ‘বিরাট ভুল’ যদি কেউ দ্বিতীয় ডোজটি না নেয়। কারণ, দ্বিতীয় ডোজটি প্রায় দ্বিগুণ সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন উভয়ই অ্যাডেনোভাইরাসগুলোর সংস্করণ সংশোধন নিয়ে কাজ করে। অ্যাডেনোভাইরাস এমন একটি গোষ্ঠী যা বিভিন্ন কোষের বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হতে পারে এবং শ্বাসকষ্টের সংক্রমণের মতো বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। অক্সফোর্ড সংস্করণে শিম্পাঞ্জি থেকে একটি অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে এবং রাশিয়ার সংস্করণে রয়েছে দুটি মানব প্রকারের মিশ্রণ।

যদিও অ্যাডেনোভাইরাসগুলো বছরের পর বছর ধরে ক্যান্সার ভ্যাকসিন এবং জিন থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য এগুলো কেবল একবারই ব্যবহৃত হয়েছিল। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ইবোলা ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়।

অন্যদিকে, মর্ডানা ও ফাইজার-বায়োএনটেক’র ভ্যাকসিনগুলো যুক্তিযুক্তভাবে আরও অগ্রগামী। উভয়টিতে এমআরএনএ’র (mRNA) অগণিত ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে, যা অ্যাডেনোভাইরাসভিত্তিক ভ্যাকসিনের মতো তবে কোভিড -১৯ এর পৃষ্ঠ থেকে স্পাইক প্রোটিনকে এনকোড করে। এগুলোই একমাত্র এমআরএনএ ভ্যাকসিন যা মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হয়েছে।

করোনাভ্যাক সংস্করণে আবার এসবের পরিবর্তে নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসের কণা রয়েছে। এই পদ্ধতিটি কম অস্বাভাবিক – ভ্যাকসিনে মৃত রোগজীবাণু ব্যবহারের ধারণাটি ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে চালু হয়। তবে, এই পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতদিন স্থায়ী হবে তা স্পষ্ট নয়। কারণ, এই ভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত কণা ব্যবহার করে ভ্যাকসিন আগে কখনও তৈরি হয়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর