ফুরিয়ে আসছে দেশি-মেটেহাঁসের অস্তিত্ব

, ফিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-08-31 00:00:00

এক সময় বাংলার জলপূর্ণ প্রকৃতিজুড়ে তাদের দেখা মিলতো। পড়ন্ত বিকেলে কোনো হাওর-নদীমহনায় কাছাকাছি গেলে ওরা ভয় পেয়ে আরো নদীগভীরে চলে যেত। কিংবা নৌকো নিয়ে নির্জন বিল-জলাশয়ে ভ্রমণ করলেই দলবেঁধে তাদের উড়ে যাবার দৃশ্য দারুণ আনন্দ দিত। বাংলার বিশেষ একটি হাঁসের প্রজাতিকে ঘিরে সেসব দৃশ্য আজ অতীত।

যে প্রকৃতিতে তারা জন্মলাভ করেছে সে প্রকৃতিতেই তারা আজ টিকে থাকতে পারছে না। সুলভ থেকে এখন তারা দুর্লভ। ঝাঁকে ঝাঁকে থেকে কমে গিয়ে এখন পৌঁছেছে কয়েকটিতে। এই বিপন্ন হয়ে যাওয়া বাংলার জলাভূমির পাখির নাম ‘দেশি-মেটেহাঁস’। ইংরেজি নাম Indian Spot-billed Duck. কেউ কেউ আবার এই পাখিটিকে পাতিহাঁস নামেও চেনেন।

দেশি মেটেহাঁসের সারাদেহ বাদামি এবং বাদামি ছিট। কালচে-বাদামি পালকের প্রান্ত মেটে রঙের। চুঞ্চু (ঠোঁট) এর প্রান্ত কড়া হলুদ। ডানার গোড়ার পালক সাদা। তবে ডানার পালক সবুজ। পুরুষের চোখের সামনে লালচে দাগ। এদের চোখ বেশ সুন্দর।

দেশি-মেটেহাঁসের উড়ার দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। ছবি: ওমর শাহাদাত

পাখি গবেষক এবং আলোকচিত্রী ওমর শাহাদাত বলেন, ‘দেশি মেটেহাঁস বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। দেশের সব জলাভূমিতে এক সময় পাওয়া গেলেও এখন সেভাবে আর নেই ওরা। প্রায়ই এদের ডিম ও ছানা চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। স্থানীয় কৃষক, জেলে ও কতিপয় দুষ্ট ছেলের দল এদের ডিম চুরি করছে নিয়মিতই। ওরা ডিম চুরি করে এনে খেয়ে থাকে নয়তো ঘরের পালা হাঁসের ডিমের সাথে ডিম ফুটানোর চেষ্টা করে। প্রজনন সংকটসহ রয়েছে জলাভূমি সংলগ্ন তার আবাসস্থল ধ্বংস।’

‘এগুলো ফলেই ওরা আজ নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে। আমাদের দেশে যেহেতু ওরা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে তাই শীতকাল ছাড়া দলে দলে আর তাদের দেখা যায় না।এরা আমাদের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখিদের দলে এসে ভিড় করে।’

ডিম ফোটানো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গৃহপালিত হাঁসের ডিমের সাথে দেশি-মেটেহাঁসের ডিম ফুটানোর চেষ্টা করে অনেকে সফলও হয়। বুনোহাস তার চিরায়ত স্বভাবের কারণে ওরা একটু বড় হলেই উড়ে চলে যায়। কিন্তু মুক্তি মিলে না সহজে। কারণ অভিভাবকহীন ছানা প্রাকৃতিক শত্রুর হাত থেকে বাঁচার কৌশল যে একেবারেই অজানা তাদের।’

জলাভূমির ধানক্ষেতের পাশে দেশি-মেটেহাঁস। ছবি: ওমর শাহাদাত

ওমর শাহাদাত আরো বলেন, ‘ছেলে ও মেয়েহাঁসের চেহারায় বিশেষ পার্থক্য নেই। দৈর্ঘ্য ৬০ সেমি এবং ওজন প্রায় ১.৪ কেজি। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে লতাপাতা এবং অমেরুদন্ডি প্রাণি। জুলাই-অক্টোবর মাসের প্রজনন ঋতুতে পানির কাছে মাটিতে লতা-পাতায় ঘাস, আগাছা ও পালকের বাসা করে ৭-৯টি সবুজে ও সাদায় মেশানো ডিম পাড়ে। মেয়েহাঁস একাই ডিমে তা দেয়। ২২ বা ২৪ দিনে ডিম ফুটে। ছেলে ও মেয়েহাঁস উভয়ে মিলে ছানা পাহারা দেয়।’

অস্তিত্ব সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মিঠাপানির জলাশয়ের এ পাখিটির নাম দেশি মেটেহাঁস। এক সময় বাংলার প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ওদেরই দখলে ছিল। আজ বিপন্ন। আজ সেই জলাভূমিগুলো মানুষের দখলে চলে যাবার পর ওরা হারিয়ে যেতে বসেছে। তারমধ্যে যারা ভাগ্যক্রমে সামান্যসংখ্যায় টিকে রয়েছে ওদের জীবনও সেই কপাল পোড়াদের মতোই। কখন যে শিকারির লোলুপদৃষ্টি গিলে খাবে তাদের!’

এভাবে শিকার অব্যাহত থাকলে সেই কয়েকটিও কমে চলে যাবে একেবারে শূন্যের কোঠায়। দেশের অনেক জলাশয়, হাওর-বিলে এখন তো তাদের দেখাই পাওয়া খুব কঠিন। এদের বসতি ধ্বংস এবং শিকারিদের ফাঁদে আটকা পড়ে তাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। এদের অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে বলে জানান আলোকচিত্রী ওমর শাহাদাত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর