বাংলাদেশই যে পাখিটির শেষ আশ্রয়স্থল

, ফিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-08-31 05:54:55

বাংলাদেশই একটি বিশেষ প্রজাতির পাখির বিচরণভূমি। পৃথিবীর কোথাও আর এই পাখিটিকে তেমনভাবে দেখা যায় না। আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- এই পাখিটির নামকরণও বাংলাদেশের নামেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- এ পাখিটি বাংলার সমস্ত প্রাণ্তর আর নলবনের বুকজুড়ে ঘুড়ে বেড়ালেও আমরা অনেকেই চিনি না এ পাখিটিকে।

নানা কারণে বাংলার প্রকৃতি থেকে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে এরা। বাংলার এই পাখিটির নাম ‘বাংলা-বাবুই’(Black-breasted Weaver)। অব্যবহৃত জায়গাগুলোতে অবহেলায় প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নিয়ে থাকা ঘাস আর নলের বনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল এই পাখিটি।

আজ আর বড় বড় ঘাস আর লম্বা হয়ে বেড়ে ওঠা দীর্ঘ নলবনের দেখা পাওয়া না। একসময়ের জনমানবহীন হাওর-বিল বা পাহাড়ি বনের পরিত্যক্ত জায়গাটুকুও আজ ভাগ বসিয়েছে মানুষ। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তারা ক্ষতিসাধন করছে প্রকৃতিগতভাবে বেড়ে ওঠা নানান জাতের ঘাস আর লতাগুল্মের।

ঘাসের উপর বসে আছে পুরুষ-স্ত্রী বাংলা-বাবুই। ছবি: ইনাম আল হক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত পাখি গবেষক এবং লেখক ইনাম আল হক বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন বাংলা-বাবুই আমাদের গ্রামবাংলায় বা বনে-জঙ্গলে প্রচুর পরিমাণে তাদের বিচরণ ছিল। বর্তমানে আমাদের অবহেলায় তারা দুস্প্রাপ্য হয়ে পড়লো। লোকে মনে করে এই পাখিটিকে তারা চেনে; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তারা এই পাখিটিকে চেনে না। অথচ এই পাখিটি একসময় আমাদের গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে ছিল। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই এর মধ্যে এই বাংলা-বাবুইটাই একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাখিটি আমাদের দেশের নামেই নামকরণ করা।’

‘যেটিকে আমরা সারাদেশে অর্থাৎ তালগাছ বা অন্যান্য গাছে ঝুলিয়ে বাসা করতে দেখি ওই পাখিটির নাম ‘দেশি-বাবুই’ (Baya Weaver)। এর সংখ্যা ভালোই বলে এই বাবুইয়ের কথাই লোকের বেশি জানা আছে। এই পাখিটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। সেই জন্যে লোকে একে চিনেও না।’

এর প্রাপ্তিস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মানুষ বেশি; পাখির জায়গা কম। এরা এখানো যে জায়গাগুলোতে কোনোক্রমে বেঁচে আছে সে জায়গাগুলো হলো- সিলেট, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী। যেমন সিলেটের চা বাগানগুলো বিভিন্ন টিলা-পাহাড়ের বাঁশ আর ঘাস রয়ে গেছে সেখানে ওরা এখনো টিকে আছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকার উঁচু ঘাসের বন ও কর্ণফুলি নদীর কোনো কোনো জায়গায় এবং রাজশাহীর পদ্মা-যমুনার বিভিন্ন চর এলাকায়।’  

ঘাস আর নলবনের অভাবে বাংলা-বাবুইয়ের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। ছবি: ইনাম আল হক

পাখিটির বাসা তৈরির কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এরা উচুঁ নলবন বা কাশবনে বাসা করে। তাই বাতাসে যাতে করে বাসাটি বেশি দোল না খায় তার জন্য তারা তাদের নির্মাণাধীন বাসায় কাঁদার প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। এদের বাসাটি দেখতে দেশি-বাবুই এর বাসার মতোই।’

পাখিটির আকার-আকৃতি ও গঠন সম্পর্কে এই পাখি গবেষক বলেন, ‘এই পাখিটিকে চেনার সহজ উপায় হলো ওর বুকের উপরে কালো রঙের বড় একটি ‘বেল্ট’ এর মতো দাগ রয়েছে। বাংলা-বাবুই আকারে চড়ুইয়ের মতো। দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার। দেহ বাদামি রঙের। বাদামি পিঠে অনেক কালচে খাড়া লাইন এবং বুকে চওড়া কালো দাগ। পেট ফিকে-বাদামি। পা হলদে।’

সংরক্ষণ বিষয়ে পাখি-বিজ্ঞানী ইনাম আল হক বলেন, ‘বাংলাদেশই এই পাখিটির শেষ আশ্রয়স্থল। কারণ পৃথিবী থেকেও বিপন্ন হয়ে গেছে ওরা। ভাগ্যক্রমে এরা এখনো সিলেট, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীর কিছু জায়গাগুলোতে অল্প সংখ্যায় টিকে আছে। আমাদের চারপাশে যেহেতু ঘাস নেই; তাই এর অস্তিত্বও এখন প্রচন্ড হুমকির মুখে। প্রথমত, মানুষকে এই পাখিটিকে চিনতে হবে। নলঘাস, হুগলা বা কাঁশের মধ্যেই সে বাসা করে; তাই এর বেঁচে থাকার জন্য ওই এলাকাগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। একমাত্র মানুষের সচেতনতাই পারে বাংলাদেশের নামে এই বিশেষ প্রজাতির বংশটিকে টিকিয়ে রাখতে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর