স্বাদে-ঘ্রাণে অতুলনীয় ঝিটকার হাজারি গুড়

, ফিচার

খন্দকার সুজন হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, মানিকগঞ্জ | 2023-08-31 22:57:58

দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি গুড়। তবুও দায় এই গুড়ের নাগাল পাওয়া। প্রকৃত হাজারি গুড় পেতে অর্ডার দেওয়ার পর অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন। তবে গুড়ের পরিমাণ ৫ কেজির বেশি হলেই বাড়বে সেই অপেক্ষার প্রহরও।

মানিকগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে রয়েছে এই হাজারি গুড়ের নাম। জেলার হরিরামপুর উপজেলায় এক সময়ে ব্যাপকভাবে হাজারি গুড়ের উৎপাদন হলেও নানা কারণে কমে এসেছে।

তবে কমেনি চাহিদার পরিমাণ। যেখানে দুই থেকে তিনশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সাধারণ খেজুরের গুড়। সেখানে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে এক হাজার ৫০০ টাকায় প্রতি কেজি গুড় কিনতে করতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের।

জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার কয়েকটি পরিবার এখন সম্পৃক্ত রয়েছে হাজারি গুড় উৎপাদনের সঙ্গে। স্বাদে-ঘ্রাণে অতুলনীয় এই গুড়ের চাহিদা রয়েছে দেশ এবং দেশের বাইরেও।

বিট্রেনের রানী এলিজাবেথ হাজারি গুড় খাওয়ার পর প্রশংসা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে

বিট্রেনের রানী এলিজাবেথ হাজারি গুড় খাওয়ার পর প্রশংসা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় এই গুড়ের উৎপাদনও কমছে দিনের পর দিন।

হাজারি গুড়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে এলাকাবাসীরা বলেন, প্রায় দুইশো বছর আগে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকায় মোহাম্মদ হাজারি নামের এক ব্যক্তি খেজুরের রস দিয়ে বিশেষ এই গুড় তৈরি শুরু করেন। তার নামেই নাম হয় হাজারি গুড়।

১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গুড় উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। আগের দিন বিকালে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে গাছ থেকে রস নামিয়ে ছেকে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির তৈরি জালা অথবা টিনের তৈরি পাত্রে চুলা জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাশের নাড়া। এ গুড় দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না। এক কেজি হাজারি গুড় তৈরিতে প্রয়োজন হয় ১২ থেকে ১৩ কেজি রস।

এক কেজি হাজারি গুড় তৈরিতে প্রয়োজন হয় ১২ থেকে ১৩ কেজি রস

শাহিদ হাজারি বলেন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। রয়েছে জ্বালানি সংকট। যে কারণে চাহিদা মোতাবেক গুড় তৈরি করা যাচ্ছে না।

এছাড়া বছরের অল্প কিছু সময় খেজুরের রস থেকে ‍গুড় তৈরি করা যায়। বাকি সময় বেকার থাকতে হয়। তাই অনেকেই পেশাও বদল করেছে। এখন ঝিটকায় হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই গুড়ের ঐহিত্য টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

প্রকৃত হাজারি গুড় পেতে অর্ডার দেওয়ার পর অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন

আবুল কাশেম হাজারি নামের এক ব্যক্তি বলেন, হাজারি গুড়ের চাহিদা বেশি থাকায় অসাধু কিছু ব্যবসায়ীরা হাজারী ট্রেডমার্ক বসিয়ে অল্প দামে ভেজাল গুড় তৈরি করে হাজারি গুড় বলে বিক্রি করে আসছে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে হাজারী গুড়ের সুনাম।

হাজারি প্রোডাক্টস মানিকগঞ্জের সত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম হাজারী শামীম বলেন, ঝিটকা এলাকার ২০ থেকে ২৫টি পরিবার প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কেজি গুড় তৈরি করেন।খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় গুড়ের উৎপাদনও কমছে।

ভেজাল প্রতিরোধ করতে চলতি বছরে রেজিস্ট্রার্ড ট্রেডমার্কযুক্ত প্যাকেটের মাধ্যমে গুড় বাজারজাত করা হচ্ছে। হাজারি গুড় টিকিয়ে রাখতে হলে রাস্তাঘাট ও পতিত জমি এবং ভিটে-বাড়ির আঙ্গিনায় বেশি বেশি করে খেজুর গাছ রোপণ করতে এলাকাবাসীর প্রতি আহবান জানান তিনি।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস বলেন, মানিকগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যের সাথে হাজারি গুড়ের নাম জড়িয়ে আছে। এই গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রশাসন সব সময় তৎপর রয়েছে। এরই মধ্যে হরিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরির দায়ে একাধিক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে।

ভেজাল গুড় উৎপাদন বন্ধে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিকার অধিদপ্তর ও স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কড়া নজরদাড়ি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর