প্রেম ও বসন্তের যুগলবন্দী

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 06:08:05

উইকঅ্যান্ডের আলস্য ও আড়মোড়া জড়ানো ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শেষ শীত সন্ধ্যাটি ছিল ভীষণ অন্যরকম। শীত প্রায় নেই। চারিদিকে বসন্তের হাতছানি। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার ভোরে পহেলা ফাল্গুনের অবারিত আলো ফুটলো বসন্তের আনন্দধ্বনিতে আর প্রেমের যুগলবন্দীতে। দিনটি যে ভালোবাসার সুধা ও সুরে ভরা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে।

পেন্ডামিক করোনার করাল গ্রাসে ক্ষত-বিক্ষত জীবন ও জগতের ধূসরিত প্রান্তর হঠাৎ আলোর ঝলকে উচ্ছ্বসিত হলো। জানান দিল, 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'। ফুলও ফুটলো। পাখিও গাইলো। বাসন্তী নবারুণে রঙিন হলো ভূমিতট। আলোর স্পর্শে প্রকৃতির সমান্তরালে জাগ্রত হলো সঙ্গরোধী-গৃহবন্দী-সামাজিক দূরত্বে আবর্তিত মানুষের তাপিত ও পীড়িত হৃদয়।

বসন্তের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের বাঙালি নন, তাবৎ বিশ্ববাসীর আবেগ, ভালোলাগা, ভালোবাসা বিজড়িত। শীতের আড়ষ্টতা ভেঙে বসন্ত আনে নবগতি ও প্রাণাবেগ। প্রকৃতির প্রতিটি সদস্য জাগে বসন্তের চিরনতুন স্পর্শে। গাছে গাছে পাখি গান গায়। ডালে ডালে প্রস্ফুটিত হয় নতুন ফুল ও পাতা। রঙের ছোঁয়ায় প্রকৃতিতে লাগে আলোর পরশ।

বসন্তের সঙ্গে অবধারিতভাবে মিশে আছে প্রেম, যার সীমানা অনির্ধারিত ও অবারিত। প্রিয়জনের সঙ্গ ও উপস্থিতির মতোই বসন্তে প্রকৃতির কোণে কোণে, নদীতে, সমুদ্রে, শৈলশিখরে, সৈকতে, বনানীতে লাগে প্রেমের প্রলেপ।

মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে বসন্ত আর প্রেম চলেছে হাত ধরাধরি করে। বিশ্ববিশ্রুত শিল্পীরা তুলির ছন্দে এঁকেছেন প্রেম ও বসন্তের রাখিবন্ধন। রেনেসাঁসের শিল্পকলার যাবতীয় আয়োজন ধন্য হয়েছে প্রেমের ও বসন্তের জয়গানে। ইতালীয় ধ্রুপদী শিল্পী, ফরাসি ইম্প্রেশনিজমের কলাকার, স্পেনের কিউবিক আর্টিস্ট ক্যানভাসে স্মরণীয় করেছেন বসন্ত ও প্রেমকে।

প্রতীচীর বর্ণবহুল আবহ ছাড়িয়ে প্রাচ্যদেশীয় শিল্পীরা চীনে, জাপানে, কোরিয়ায় শিল্পকলার ঘরানায় জাগ্রত করেছেন বসন্ত বাহার ও প্রেমের গৌরব। শিল্প-সুষমার সুপ্রাচীন জনপদ পারস্যদেশে বসন্ত পেয়েছে মহাকাব্যিক ব্যাঞ্জনা আর প্রেম লাভ করেছে স্বর্গীয় আবেশ। মিনিয়াচার আর্ট ফর্মের সেই প্রকরণ পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া পেরিয়ে মুঘলদের হাত ধরে এসেছে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে। নওরোজ, নববর্ষের বর্ণিল আয়োজনের মতো পালিত হয়েছে প্রেম ও সৌন্দর্যের 'বসন্ত উৎসব'।

নদীমাতৃক, প্রকৃতিময়, উৎসব-পার্বণ মুখরিত বাংলাদেশে বসন্ত শুধু প্রকৃতি বা ক্যালেন্ডারের পাতাতেই আসেনা, আসে মানুষের যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক চর্চায়। তারুণ্যের লেলিহান দীপ্তিতে নগরে-গঞ্জে বসন্ত বরণ করা হয় আলোয়, রঙে, গানে, নৃত্যে। আত্মা ও শরীরে বসন্ত বাতাস মেখে যুথবদ্ধ মানব-মানবী যৌথ পদভারে প্রেমের সরণি বেয়ে পৌঁছে যায় অম্লান প্রকৃতির সুগভীর অলিন্দে।

বছরব্যাপী করোনাকালের সুতীব্র দাহ ও দহন হয়তো বসন্তের বাঁধভাঙা আয়োজনকে সীমিত করবে। শঙ্কিত মানুষ পারস্পরিক বাহুবন্ধনে মিলিত হবে নিজের নিরাপদ বলয়ে। বিবরের ঘেরাটোপ ছেড়ে উদার প্রকৃতিতে বাসন্তী তরঙ্গে মিশে যেতে শঙ্কা ও ভীতি কবলিত হবে অনেকেই। 

তথাপি আগ্রাসী নগরায়ন-দানবের হাত গলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনার নীলাকাশে রক্তিম আভায় মাথা তুলবে কিছু কিছু অপরাজেয় শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া। প্রেমে ও প্রকৃতিবন্দনায় কতিপয় সাহসী তরুণ-তরুণী দখিনা বাতাসে ভেসে বেড়াবে। তাদের বাসন্তী শাড়ি জীবনের পতাকার মতো দুলবে। প্রেমের অজেয় সঙ্গীত তাদের কণ্ঠস্বরের ধ্বনিমালায় মিশে যাবে সমগ্র চরাচরে। বাংলার, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসারিত আঙিনায় প্রেম ও বসন্তের যুগলবন্দীতে করোনার অন্ধকার মুছে মুখরিত হবে অনিঃশেষ-প্রাণের অন্তহীন-স্পন্দন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর