সবুজ প্রকৃতিতে হঠাৎ হলদে সৌন্দর্য

, ফিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-09-01 09:02:49

আমাদের প্রকৃতিতে হঠাৎ করে হলুদ একটি পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে চলে আসে। আমরা তা হঠাৎ করে দেখে বড়ই অবাক হয়ে যাই। এ ডাল-সে ডাল হয়ে হলুদময় এ সৌন্দর্য একেকটি ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে অবস্থান নিতে থাকে। তবে সে এতোই চঞ্চল যে, তাকে বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ সে আপনাকে দেবে না।

অপূর্ব পাখির এমন সৌন্দর্যভরা বিচরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে তার পিছু নিতে ইচ্ছে করে। দারুণ এই সৌন্দর্যময় পাখিটির নাম ‘বেনেবউ’। তবে কুটুমপাখি, বউ কথা কও, হলদিয়া, ইস্টিকুটুম, সোনা রঙের পাখি এইসব নামে ডাকা হলেও ‘হলদে পাখি’ নামটি অধিক প্রচলিত। এর ইংরেজি নাম Black-hooded Oriole এবং বৈজ্ঞানিক নাম Oriolus xanthornus|

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং বরেণ্য পাখি-বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, ‘বেনেবউ পাখিকে দেখে আমার নিজের মন ভালো হয়েছে বহুবার। এমন সুকুমার গড়ন, এমন মন মাতানো সোনা রং শরীর, এমন চনমনে ভঙ্গি পাখিটির! এমন সুন্দর প্রাণোচ্ছ্বল ও মিষ্টিভাষী পাখির দেখা পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। ঢাকা নগরীতে যেখানে দু’তিনটি বৃক্ষ আছে সেখানেই জোড়া বেঁধে এসে এরা জোরে-শোরে ডাকে ‘চী-ঊ, চী-ঊ’। হলদে পাখি নাম দিলে কি হবে, পাখিটি পুরোপুরি হলদে নয়। এর মুখ, মাথা, গলা ও ঘাড়ে এবং লেজের কিছু কিছু অংশে আভিজাত্য ভরা উজ্জ্বল কালো রং। এর ঠোঁটের রংটা দেখুন - কী অপূর্ব মিষ্টি একটা রং!’

শিকারের সন্ধানে ডালে ডালে বেনেবউ। ছবি: মো. দেলোয়ার হোসেইন

‘বেনেবউ’ এর নামকরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, হলদে পাখি নামটি আমরা যুক্তিসঙ্গত কারণেই বেছে নেইনি। এর ব্যাখ্যাটি হলো- এই হলদে পাখি এ নামটি দ্বারা এই পরিবারের অন্যান্য পাখিগুলোকে পরিষ্কারভাবে বোঝানো যায় না। অর্থাৎ এই পরিবারের এখন প্রথম পাখিটিকে যদি ‘হলদে পাখি’ হিসেবে ধরি তাহলে চতুর্থ পাখিটিকে বলতে হতো ‘খয়রা হলদে পাখি’। এমনটি বললে ভীষণ অদ্ভুত শোনাতো! আমরা ‘খয়রা বেনেবউ’ বলতে পারি কিন্তু কখনোই ‘খয়রা হলদে পাখি’ বলতে পারি না। এক পরিবারে একটি খয়রি রঙের থাকার কারণে পাঁচটি পাখিকেই হলদে বলা সম্ভব হচ্ছে না।

ইনাম আল হক আরো বলেন, একই পরিবারের ৫টি পাখিকে কখনোই পাঁচটা নাম দেয়া যায় না। আর এটা মনেও রাখাও সম্ভব নয়। গ্রামের লোকের জন্য হয়তো ঠিক আছে। কারণ গ্রামের লোকেরা গোটা বিশেক পাখির নাম মনে রাখেন। কিন্তু যখন বৃহৎ ব্যবহারের জন্য সারাদেশের ৭০০ পাখির নাম নিয়ে আমরা ভাববো তখন পাখিদের নাম-পরিচয়টাও হতে হবে আলাদা-আলাদা এবং নির্ভুল। তাই এটি যুক্তিযুক্ত নয় বলেই আমরা হলদে পাখি বাদ দিয়ে বেনেবউ নামটি গ্রহণ করেছি। পশ্চিমবঙ্গেও এ পাখিটিকে বেনেবউ নামকরণ করা হয়।

অন্যপাখির ছানা প্রতিপালন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মজার ব্যাপার হচ্ছে বেনেবউকে মাঝে-মাঝে চোখগেলো পাখির ছানা লালন-পালন করতে দেখা যায়। বেনেবউয়ের বাসায় চোখগেলো পাখি গোপনে ডিম পেড়ে গেলে বেনেবউ-দম্পতি দিব্যি সে ডিম ও ছানার পালক পিতা-মাতা হয়ে যায়। চোখগেলো পাখি বেনেবউয়ের চেয়ে আকারে এবং ওজনে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়ে থাকে।’

বেনেবউয়ের শিকার ধরার ঝটিকা অভিযান। ছবি: মো. দেলোয়ার হোসেইন

চোখগেলোর একটি ছানাকে বড় করতে গিয়ে নিজের তিনটি ছানা পালার সমান পরিশ্রম হয় বেনেবউয়ের। তবু বেনেবউরা কোনোদিন পালক পিতা-মাতার দায়িত্বে বিন্দুমাত্র অবহেলা করে না। পরের ছানা লালন-পালনের পালার মহান কাজটুকু করে বেনেবউ কিন্তু নিজের বংশবৃদ্ধি করার কাজে মোটেই পিছিয়ে পড়েনি। তা হলে তো দেশ থেকে বেনেবউ পাখি উৎখাত হয়ে যেতো বলে জানান প্রখ্যাত পাখি বিজ্ঞানী ইনাম আল হক।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্র জানায়, বেনেবউয়ের দৈর্ঘ্য ২৫ সেমি এবং ওজন ৮০ গ্রাম। ফল, ফুলের মধু এবং সব ধরণের পোকা ধরে খায় এরা। বিভিন্ন ধরণের গাছপালায় নানাজাতের পোকা ধরে খেতে পারে বলে সে ভালোভাবে টিকে রয়েছে। পৃথিবীতে ২৯ প্রজাতির বেনেবউ আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামসহ এই দশটি দেশে এদের বিস্তৃতি রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর