'তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি'

, ফিচার

কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:26:40

'তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। তোমার সেবার মহান দুঃখ সহিবারে দাও ভকতি।' -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের উত্তাল দিনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতি মুক্তির দিশায় ছিল আলোড়িত। জাতিসত্তার পক্ষে তখন প্রথমবারের মতো উত্তোলন করা হয় নিজস্ব পতাকা। স্বাধীনতার সর্বাত্মক ও সশস্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে উদ্বেলিত জাতি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে ২ মার্চ।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বাঙালি জাতি বা রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। গাঢ় সবুজ বর্ণের আয়তক্ষেত্রের মাঝখানে একটা ভরাট রক্তিম বৃত্ত নিয়ে এটা তৈরি। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০:৬। পতাকার মাঝখানের লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ পতাকার দৈর্ঘ্যের ৫ ভাগের একভাগ।

বাংলা 'পতাকা' একটি সংস্কৃতজাত শব্দ। ‘পত্‌’ ধাতু থেকে এর উৎপত্তি। পত্‌ অর্থ ধাবিত হওয়া, উড্ডীন হওয়া ইত্যাদি। পতাকার একটি ধ্বন্যাত্মক সম্পর্কও রয়েছে; কারণ পতাকা বাতাসে উড়লে 'পত্‌ পত্‌' শব্দ হয়। লাতিন শব্দ 'ভেক্সিলাম' থেকে ইংরেজি ভাষার ফ্ল্যাগ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ পতাকা। অন্য ভাষায় নিশান, ঝাণ্ডা, কেতন, ধ্বজা, বৈজয়ন্তী প্রভৃতি নামেও অভিহিত হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩০ অব্দে পারস্যে এক ধরনের পতাকার প্রচলন ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদল সমন্বয়ের কাজে প্রথম পতাকা ব্যবহার হয়েছিল। মধ্যযুগে পতাকার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবেই নয়, বিভিন্ন কাজের সমন্বয়ের জন্য নানা আয়তন, রঙ ও নকশায় এটা তৈরি করা হতো।

১৩ শতকে ডেনমার্কে রাষ্ট্রীয় পতাকার প্রচলন ঘটে। এটাকেই সবচেয়ে পুরনো রাষ্ট্রীয় পতাকা হিসেবে ধরা হয়। ১৬৩০ সালের পর এ ধরনের পতাকা তৈরিতে লাল, নীল ও সাদা রঙয়ের ব্যবহারই বেশি দেখা যায়। ১৭৭৭ সালের ১৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৭৯৪ সালে ফ্রান্সে জাতীয় পতাকার উদ্ভব ঘটে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়।

জাতীয় পতাকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে ঐতিহাসিকভাবেই অপরিসীম। এতে নিহিত থাকে একটি দেশের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস। পতাকার আয়তন, রং, ধরন ও ব্যবহারে দেশে দেশে ভিন্নতা থাকলেও উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন অর্থাৎ দেশের প্রতিনিধিত্ব করা বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীয় পরিচয় তুলে ধরা। জাতীয় পতাকার উত্তোলন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা দেশে নানা রকম বিধি বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, ১৯৭২ সালে ১৭ জানুয়ারী সরকারীভাবে জাতীয় পতাকা ব্যবহার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, প্রণয়ন করা হয় বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২ (সংশোধিত- ২০১০)। বর্তমানে পতাকার যে রুপ আছে তা নির্ধারণ করা হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহৃত পতাকার ওপর ভিত্তি করে।

ত্রিশ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে লাল সবুজের এক ভূখণ্ড ছিনিয়ে এনেছে সাহসী সংগ্রামী বাঙালি জাতি। ভোরের আকাশে উদীয়মান লাল সূর্য ও দিগন্তজোড়া সবুজ এই দুই অকৃত্রিমতাকে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় এই দুইটি বিষয়কে স্থান দেওয়া হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর ৪নং অনুচ্ছেদ এবং বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২ (সংশোধিত- ২০১০) এর ৩নং বিধি অনুযায়ী ‘জাতীয় পতাকা’ গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। পতাকার দৈর্ঘ্যের নয় বিংশতিতম অংশ হতে অঙ্কিত উল্লম্ব রেখা এবং পতাকার প্রস্থের মধ্যবর্তী বিন্দু হইতে অঙ্কিত আনুভূমিক রেখার পরস্পর ছেদ বিন্দুতে বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু হবে।

জাতীয় পতাকার উত্তোলন ও ব্যবহার সম্পর্কে সুনিদিষ্ট বিধি-বিধান থাকলেও সঠিকভাবে মেনে চলার প্রবণতা খুব কমই দেখা যায়। যার ফলে পতাকার অবমাননা হচ্ছে যা দণ্ডনীয় অপরাধ। পতাকা দ্রুততার সাথে উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে নামাতে হবে। বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা ১৯৭২ (সংশোধিত- ২০১০) এর ৪ (২) বিধি অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস, ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোন দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে।

বাঙালি জাতির রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে, ২ মার্চ ১৯৭১ সালে পতাকা উত্তোলিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৩ শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এর বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে সরকারিভাবে গৃহীত হয়।বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাস আবেগের। এই পতাকা পুরো দেশকে ধারণ করেছে তার বুকে। লাল- সবুজে মিশে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গন পেরিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার স্মৃতি। জাতীয় পতাকার আলোচনায় আমাদের জাতীয় সংগীত রচয়িতার অসাধারণ পঙ্ক্তি সুদৃঢ় ভিত্তিতে পুরো জাতিকে উজ্জীবিত করে: ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’।

এ সম্পর্কিত আরও খবর