নেতা ও জনতার বন্ধন ৭ মার্চ

, ফিচার

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-30 06:11:43

ক্যালেল্ডারের পাতা নাকি হুবহু একই? ২০২১ এ ফিরে এসেছে ১৯৭১। আজ ৭ মার্চ রোববার, ১৯৭১ এর ৭ মার্চও নাকি রোববার ছিল? একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের আমি। তাই আশান্বিত হয়ে উঠতে চাই এই তথ্যে। আবার একথাও জানি তারিখ ফিরে এলেও সময় ফিরে আসেনা। আসেনা ফিরে হারানো মানুষটিও। একাত্তরের উত্তাল মার্চের সঙ্গে আজকের দিনটিকে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই । তখনকার রাজনৈতিক অনিবার্যতার সঙ্গে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে নেই এক অবস্থানে। একাত্তর আমাদের স্বাধীন একটি দেশ উপহার দিয়েছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও ভীত দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তৈরি হলেও, মুক্তির  আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ  একাত্তরে শুরু ও শেষ । মুক্তির ডাক রাজনীতির নানা পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজনৈতিক নেতারা নানা ইঙ্গিত ও কৌশলে দিয়েছেন। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনকেও মুক্তির ডাকের অংশ বলা যেতে পারে। কিন্তু জনমানুষকে রণাঙ্গনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য আহবান বা ডাক, সেই  আহ্বানটি এসেছে আজকের দিনে অর্থাৎ সাতই মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন গোটা পূর্ববাংলার মানুষ এসে জড়ো হয়েছিলেন। ময়দান ভরে গিয়েছিল মুক্তির তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত মানুষে। তাদের তৃষ্ণা মেটানোর একটাই উপায় ছিল, সেই উপায়টি জানতেন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম । তৃষ্ণায় চৌচির বুকে যেন মু্ক্তির জলের বান এলো। জনসমুদ্র আরো উত্তাল হলো যখন  নেতা বললেন- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। আমরা যখন মরতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবে না। নেতার এই উচ্চারণ গুলো জনসমুদ্রের উর্মিতে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। জনমানুষের মুক্তির আফাল তৈরিতে আর কোন বাধা রইলো না। মুক্তিকামী মানুষ বার্তা পেল, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প তাদের সামনে নেই।

এই যে পুরো জাতিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঙ্গে যুক্ত করা, এই কাজটি কিভাবে সম্ভব হলো? সেদিন যারা শারীরিক ভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হয়েছিলেন, আর যারা ছড়িয়েছিলেন পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের নানা প্রান্তে, তাদের মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না। সকলে একপ্রাণ, এক দেহ যেন হয়ে উঠেছিল। সবাইকে এভাবে এক করার মন্ত্রটি জানাছিল নেতার। তিনি জানতেন দেশের মানুষকে কি করে এক সুরে বাঁধা যায়। এক সুরে সকলকে বাঁধতে হলে জনগণের সঙ্গে নেতার আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হওয়া জরুরি।  আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখতে পাবো, জনগণের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারা, জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পারা, নেতা বিরল। কয়েকটি নাম হয়তো উচ্চারিত হতে পারে, সেখানে প্রবল ভাবে আছেন বঙ্গবন্ধু। জনগণের সঙ্গে আত্মিক বাঁধন কতোটা দৃঢ় ও গভীর হলে তবেই, তাদের ‘তোমরা’ সম্বোধন করা সম্ভব হয়। জনগণ যেন এই সম্বোধনটি শোনার জন্যে উন্মুখ হয়ে ছিল ।

বঙ্গবন্ধু জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের যে রাখি বেঁধেছিলেন, পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতারা রাখির সেই বন্ধন অটুট রাখা তো দূরের কথা বাঁধার উদ্যোগটিও নিতে পারেনি। একথাও সত্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জনগণের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে একের পর এক  ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে, এক পর্যায়ে নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে হলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা পট পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ নানা সংকটের মুখে পড়েছে, সেই সংকটের কোন কোনটিতে পুরো বাংলাদেশকে এক করার প্রয়োজন ছিল, দুই একবার মনে হয়েছে , এই বুঝি বাংলাদেশ ফিরে গেল একাত্তরের যৌথ সম্পর্কের রসায়নে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জনগণের যে রসায়ন তৈরি হয়েছিল, সেই রসায়নে ফিরে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় এসেছে। ভোট ছাড়া হোক আর ভোটের মাধ্যমে হোক, এসে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছে. তারা জনগণের জন্য নিবেদিত। কতো কর্মসূচি, কতো উন্নয়ন। জনগণ সেগুলো হয়তো ভোগও করেছে, করছে। কিন্তু সেই উপভোগে তৃপ্তি নেই। কারণ পরিবেশনে অনুপস্থিত সেই আদর। যেটি সাতই মার্চ ১৯৭১ এ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু । ২০২১ এর অনিবার্যতা হলো, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সকল রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে খুঁজে বের করতে হবে কেন জনগণ ও নেতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো। কেন সম্পর্ক দানা বাঁধছে না। একজন বঙ্গবন্ধু, একাত্তর ও সাত মার্চ যাদের ইতিহাসের অংশ, তারা কেন রাজনৈতিক অনুশীলনে কেন বার বার অমনোযোগী হয়ে পড়ছে?

তুষার আবদুল্লাহ, লেখক ও গণমাধ্যম কর্মী

এ সম্পর্কিত আরও খবর