আধুনিক জগতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সরকার ব্যবস্থায় রাজা বা রানি শাসন করেন না। জনগণই তাদের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনের অধিকারী। তবুও ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও পরম্পরাকে মান্য করে বিশ্বের কোনো কোনো দেশে রাজা বা রানিকে আলঙ্কারিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। তেমনি একজন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপ পরলোক গমন করলেন ৯৯ বছর বয়সে।
দৃৃশ্যত ক্ষমতাহীন হলেও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ (এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি; জন্ম ২১ শে এপ্রিল ১৯২৬) হলেন যুক্তরাজ্যে রানি এবং আরও ১৫টি কমনওয়েলথ রাজ্যের রানি। সেই সূত্রে স্বামী প্রিন্স ফিলিপও ছিলেন উচ্চতম মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী।
১৯২১ সালের ১০ জুন গ্রিস ও ডেনমার্কের রাজপরিবারে জন্ম হয় ফিলিপের। তবে তিনি গ্রিসের দ্বীপ কর্ফুতে তিনি জন্ম নেন। সাত বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে আসেন। সেখানে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে কেনসিংটন প্যালেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ১৮ বছর বয়সে তিনি রয়্যাল নেভিতে যোগ দেন ও ব্রিটেনের রয়্যাল নেভি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রিন্স ফিলিপ। তাদের চারটি সন্তান রয়েছে: চার্লস, ওয়েলসের যুবরাজ; অ্যান, প্রিন্সেস রয়েল; যুবরাজ অ্যান্ড্রু, ইয়র্ক এর ডিউক; এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড, ওয়েলেক্সের আর্ল। এলিজাবেথ তার ভবিষ্যত স্বামী, গ্রিস এবং ডেনমার্কের প্রিন্স ফিলিপের সাথে দেখা করেছিলেন ১৯৩৪ এবং ১৯৩৭ সালে। ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে ডার্টমাউথের রয়্যাল নেভাল কলেজে আরেকটি বৈঠকের পরে, এলিজাবেথ - যদিও তার বয়স মাত্র ১৩ বছর - তিনি বলেছিলেন যে তিনি ফিলিপের প্রেমে পড়েছেন এবং তারা চিঠি আদান-প্রদান শুরু করে। ৯ জুলাই ১৯৪৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বাগদানের ঘোষণা দেওয়া হলে তিনি তখন ২১ বছর বয়সে ছিলেন।
বাগদানটি বিতর্কিত ছিল। ফিলিপের কোনও আর্থিক অবস্থান ছিল না, বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার বোনেরা ছিল সমালোচিত, যাদের সাথে নাৎসি জার্মান অভিজাতদের বিয়ে হয়েছিল। ব্রিটেনের রাজার কিছু উপদেষ্টা ফিলিপকে যথেষ্ট ভালো পাত্র মনে করেননি। তিনি বাড়ি বা রাজ্য ছাড়া রাজপুত্র ছিলেন। তবে বিয়ের কারণে সবাই তাকে 'একজন ইংরেজ ভদ্রলোক' বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
বিয়ের আগে ফিলিপ তার গ্রিক ও ডেনিশ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। ধর্মীয় দিক দিয়ে নিজেকে গ্রিক অর্থোডক্সি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাঙ্গেলিকানবাদে অনুগত খ্রিস্টানে রূপান্তরিত করেছিলেন। বিয়ের ঠিক আগে, তাকে এডিনবার্গের ডিউক করা হয়েছিল এবং তাকে রয়্যাল হাইনেস স্টাইলটি প্রদান করা হয়ো।
এলিজাবেথ এবং ফিলিপ লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর বিয়ে করেছিলেন। তারা বিশ্বজুড়ে ২,৫০০টি বিয়ের উপহার পেয়েছিল। ব্রিটেন তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্ততা থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেনি। তাই এলিজাবেথকে তার গাউনটির জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে রেশন কুপনের প্রয়োজন ছিল, যা নরম্যান হার্টনেল ডিজাইন করেছিলেন। যুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে ফিলিপের তার তিন বেঁচে থাকা বোনসহ জার্মান সম্পর্কের আত্মীয়দের বিয়েতে আমন্ত্রণ জানানো নিয়েও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
প্রেমে, প্রণয়ে, কঠিন পরিস্থিতিতে প্রিন্স ফিলিপ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে ৭৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের অধিকারী হয়েছেন, যা শুক্রবার (৯ এপ্রিল) পরিসমাপ্তি ঘটে। রাজকীয় বাকিংহাম প্যালেসের পক্ষে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ জানাচ্ছেন, তার স্বামী প্রিন্স অব এডিনবরা ফিলিপের মৃত্যু হয়েছে।’ শুক্রবার সকালে উইন্ডসর ক্যাসেলে তার মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। যদিও ফিলিপের শেষকৃত্যের ব্যাপারে এখন সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে মনে করা হচ্ছে, তার ইচ্ছানুসারে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্যের পরিবর্তে রাজকীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত কর হবে।
প্রায় মাস খানেক হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সম্প্রতি তিনি ছাড়া পান। হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। রাজপরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, করোনাকালের লকডাউনের গোটা পর্ব রানি ও ফিলিপ উইন্ডসর ক্যাসেলে কাটান। সামান্য কয়েক জন স্টাফ ছিলেন তাদের সঙ্গে। জানুয়ারি মাসে দু’জনেই করোনা ভ্যাকসিন নেন।
দীর্ঘ সংসার জীবনের আগে তাদের সম্পর্ক প্রেমের কাহিনিতে পরিণত হয়। বিয়ের কিছুদিন পরে এলিজাবেথ তার বাবা-মা’কে একটি চিঠিতে লেখেন, ‘আমরা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে ব্যবহার করি, যেন আমরা পরস্পরের বহু দিনের চেনা।’ ৫০তম বিবাহবার্ষিকীতে ১৯৯৭ সালে রানি বলেন, ‘আমার জীবনে ওর গভীর প্রভাব রয়েছে। উনি আমার শক্তি।’
ব্রিটিশ রাজপরিবারের উদারতা ও আধুনিকীকরণে প্রিন্স ফিলিপের ভূমিকা ছিল অন্যতম। আর ছিল খ্যাতনামা স্ত্রী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সুদীর্ঘ বছরের সাফল্যের নেপথ্যে নীরব ও গোপন আত্মত্যাগ। তার মৃত্যুতে ব্রিটিশ রাজকীয় ইতিহাসের এক শতবর্ষস্পর্শী ঐতিহ্যের চিরঅবসান হলো।