পলাশীর ২৬৪ বছর

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 09:56:46

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ২৬৪ বছর আগে (১৯৫৭-২০২১) পলাশীর যুদ্ধে (২৩ জুন) পরাজিত হলে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় ইংরেজদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনাকারী পলাশীর যুদ্ধ, যত না 'যুদ্ধ' ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল ষড়যন্ত্র। মাত্র কয়েক মিনিটের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নবাবের সেনাপতি ও সৈন্যরা ইতিহাসের ভাষ্যে 'পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল'। বিপুল শক্তি থাকা সত্ত্বেও 'নিকটজনের ষড়যন্ত্রের কারণে' নবাব সিরাজ পরাজিত হন এবং পালাতে গিয়ে ধৃত হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হন, এমনটিই ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত অভিমত।

রাজনীতিতে  ও ইতিহাসে 'নিকটজনের ষড়যন্ত্র' একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ইস্যু। রোমান বীর সিজার নিহত হন নিকটজন ব্রুটাসের হাতে। মুঘল ইতিহাসে পাতাগুলো নিকটজনের রক্তে রঞ্জিত। মুঘল দরবারে ভাইবোন ও আত্মীয়দের ষড়যন্ত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল তাদের রক্তের দাগ। সুদূর অতীত থেকে সর্বসাম্প্রতিক বর্তমান পর্যন্ত এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। 

ইতিহাসের নানা পর্বে চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক পালাবদলে নিকট বা আপনজনের ভূমিকা বহু গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অক্সফোর্ড প্রেস থেকে প্রকাশিত আশীষ নন্দির বই 'The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self Under Colonialism' এক্ষেত্রে অন্যতম।

ঐতিহাসিক বিশ্লেষকদের মতে, নিকটজনদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রই পলাশীতে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ও ইংরেজদের বিজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। নবাব শিবিরের সবাই ঐক্যবদ্ধ ও একাট্টা থাকলে ক্ষুদ্র ইংরেজ বণিকগণ ধূলিসাৎ হয়ে যেতো। আগেও ঐক্যবদ্ধ বাংলা সিরাজের পূর্বসূরি আলীবর্দি খানের নেতৃত্বে বর্গি-মারাঠাদের বিশাল বাহিনিকে পরাজিত করার সক্ষমতা ও সাফল্য দেখিয়েছে। পলাশীতে তা দেখানো সম্ভব হয়নি। নবাব সিরাজের প্রধান  সেনাপতি মীর জাফর ছাড়াও তাঁর আপন খালা ঘসেটি বেগম ছিলেন বিরুদ্ধে।

ক্ষমতার অলিন্দে এমন মতবিরোধ ও ভিন্নমত আকছার থাকে। কিন্তু সকল বিরুদ্ধবাদীদের একত্রিত করে ইংরেজদের এনে ষড়যন্ত্র সফল করেছিলেন ধনপতি জগৎশেঠ। রাজস্থানের মাড়োয়াড় অঞ্চলের ব্যবসাদার, জৈন ধর্মাবলম্বী শেঠ গোষ্ঠী নবাবের পূর্বপুরুষদের দয়ায় বাংলায় স্থান লাভ করলেও নিজস্ব লাভ, লোভ ও স্বার্থের কাছে মাড়োয়াড়ি গ্রুপ নীতি, নৈতিকতা, বিশ্বস্ততা বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। নবাব-বিরোধী পক্ষ আর ইংরেজের মধ্যে একাধিক দূতিয়ালি, বৈঠক ও চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মাড়োয়াড়িরা 'অর্থনৈতিক কূটনীতি'তে সফল হন। কিন্তু তাতে বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতার অবসান ঘটে।

পরিশেষে, ষড়যন্ত্রকারীগণও প্রকৃত অর্থে কিছুই পাননি। ইতিহাসে ষড়যন্ত্রমূলক কাজের সঙ্গে জড়িতরা শেষ পর্যন্ত পুরস্কার-স্বরূপ 'চরম মূল্য'ই পেয়েছেন জীবন ও মান-সম্মান হারিয়ে। মীর জাফর সিংহাসন লাভ করলেও ইংরেজদের দ্বারা চরমভাবে অসম্মানিত হন। তাঁর না ছিল ক্ষমতা, না ছিল সম্মান বা মর্যাদা। ইংরেজ ও তাদের দোসর পরিবেষ্টিত মুর্শিদাবাদের দরবারে তিনি ছিলেন হাসির খোরাক ও উপহাসের পাত্র।

আরেকজন ঘসেটি বেগম নবাব সিরাজের পতনের পরপরই বন্দি হয়ে ঢাকার অদূরে জিঞ্জিরা প্রাসাদে নির্বাসিত হন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়। অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল না। সকলেই অপমানজক ও নির্মম পরিণতির শিকার হন।

২৬৪ বছর আগে পলাশীর ঘটনায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলেও তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয়, যার কিছু কিছু এখনও প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর