'বর্ষাবন্দনা' ও মালদার নদী ভাঙন

, ফিচার

রূপ কুমার বর্মণ ও কাজী কামাল নাসের, কলকাতা | 2023-09-01 09:21:39

সংস্কৃত মহাকবি কালিদাস বর্ণিত এবং ঋতুচক্রের আবর্তে আগত বর্ষার শুরুতে ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ থেকে অবিরাম বৃষ্টিধারার সঙ্গে গুরু গুরু মেঘের ডাক বাঙালির কবি মনে আনন্দের বান ডেকে আনবে, এনিয়ে কারো মনে কোন সন্দেহ নেই। দুকুল ছাপিয়ে পাহাড়ি নদীর কুলকুল ধারা প্রতিবছর সমতল ডিঙিয়ে নদীমাতৃক বাংলার হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। কবির কলমে সৃষ্টি হয় বর্ষাবন্দনার মিষ্টি কাব্য। তাই কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ বা আধুনিক কবিরাও বর্ষামঙ্গল রচনায় কখনই কার্পণ্য করেননি। স্বভাবিকভাবেই বাদল মুখরিত নিশীথে গায়ক-গায়িকারাও বর্ষাবন্দনায় মেতে ওঠেন। কল্লোলিত প্রথম কদম ফুলের সুবাসে সঙ্গীতের নবধারা জলে স্নাত স্নিগ্ধ বাতাশের স্পর্শ বর্ষাকে অনেকের কাছেই করে তোলে অতি প্রিয়। আর এই বর্ষা যদি উত্তরবঙ্গের হয় তাহলে সেটা তো কবিদের কাছে এক কথায় অতুলনীয়!

তবে বর্ষায় উত্তরবঙ্গের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেই রূপ অনেক বেশি ভয়ংকর। আষাঢ়-শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারায় গঙ্গা-পদ্মার সুস্বাদু ইলিশের মোহে মজে থাকা কবি, পর্যটক বা শহরবাসী সাহিত্যিরসিকদের দৃষ্টির বাইরে থাকা বর্ষার উত্তরবঙ্গকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের তাকাতে হবে এখানকার নদী ভাঙনের দিকে।

নদীতীরের বাড়িঘর বা কৃষিজমির ভাঙন নদীমাতৃক পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত দুর্যোগ। পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মালদায় প্রতি বছর অতি বৃষ্টি, বন্যা ও নদী ভাঙনের মত  প্রাকৃতিক দূর্যোগের জন্য বিপুল পরিমাণে সম্পদ ধ্বংস হয় ।

১৯৯৮ সালে মালদার টানা তিন মাসের বন্যাতে প্রায় ৮৭৮.৫৮ কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ নিজেদের বাসভূমি হারিয়ে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষে (Internally Displaced Persons) পরিণত হয়েছেন। বিশ শতকের শেষ তিন দশকে (১৯৬৯-১৯৯৯) মালদা জেলায় গঙ্গার বাম তীরের ভাঙনের ফলে প্রায় ৪.৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তবে সমস্যা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। মালদা জেলার ভূতনি অঞ্চল থেকে কলিয়াচক পর্যন্ত নদী ভাঙনের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বছরের পর বছর। রতুয়া, মানিকচক, ইংলিশ বাজার, বৈষ্ণব নগর, মোথা বাড়ি ও কালিয়াচক অঞ্চলের প্রায় কয়েকশ একর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

‘গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি'র জরিপে দেখা গিয়েছে যে কালিয়াচক ও মানিকচকের ৭৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ক্ষতি হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে এই অঞ্চলের ৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৪টি উচ্চ বিদ্যালয়। বছরের পর বছর নদী ভাঙনের ফলে দুই অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার পরিবার। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা মনে করেন তাদের মূল সমস্যা শুরু হয়েছিল ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পর। ফারাক্কার বাঁধ তৈরির পর গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনে ২০০২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮৫৬ কোটি টন পলি গঙ্গা গর্ভে সঞ্চিত হয়েছে। তাই গঙ্গা দ্রুত খাত বদলানোর চেষ্টায় পাড় ভেঙে চলেছে। গঙ্গার গ্রাস থেকে বাদ পড়েনি অন্যান্য ছোটো ছোটো নদীও। পঞ্চানন্দপুরের কাছে থাকা পাগলা নদীর চিহ্ন ২০২১ সালে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

গঙ্গার পাড় ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত কলিয়াচক ২নং ব্লকের কাকৃবনা, ঝাওবনা, গোপালপুর ও রহিমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাস্তুচ্যুত মানুষেরা তাঁদের সঙ্কট মোচনের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ নাগরিক কমিটি'। এই কমিটি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে চলেছে কয়েক দশক ধরে। গঙ্গা ভাঙ্গনে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের বাসিন্দারা কৃষিজমি হারিয়ে রুজি-রোজগারের আশায় পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে। 

নদী ভাঙনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গঙ্গার বুকেও উঠছে একের পর এক চর।  মানিকচক ও মথুরাপুরের মাঝে ফূলহার ও গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা প্রায় ৭ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত এমনই একটি চরের নাম হল ‘ভূতনি’। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভূতনি চর ঠিকই ছিল। চরের লক্ষাধিক মানুষ চৈত্র মাসে তাদের জমিতে ভাদুই ধান বুনতেন ও বর্ষার পর জেগে ওঠা চরের জমিতে তারা বুনতেন কলাই । অগ্রহায়ণ মাসে শুরু হতো কুমড়ো ও তরমুজ চাষ। কৃষিকে কেন্দ্র করে ভূতনিতে গড়ে উঠেছিলো এক মজবুত অর্থনীতি। ১৯৭৬ সালের পর থেকে ভূতনি অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ বাড়তে থাকে। ভূতনিকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয় ‘ভূতনি রিং বাঁধ’। এই বাঁধ দিয়ে ভূতনির কিছু অংশ বাঁচানো গেলেও কৃষিকাজে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে এই অঞ্চলের মানুষদের অনেকেই নিজের গ্রাম ছেড়ে মালদার মূল শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

২০১৭ সালে মালদার উত্তর পশ্চিম (মূলত রতুয়া ১নং ও রতুয়া ২নং ব্লক) অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ শুরু হয়। ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে মহানন্দা টোলা, বিলাইমারি ও মহান  টোলা অঞ্চলের বহু একর জমি চলে গিয়েছে নদী গর্ভে । ২০২১ সালের বর্ষায় মানিকচক অঞ্চলে ভাঙন আবার ভয়ানক রূপ নিয়েছে।

বন্যা ও ভাঙনের  ফলে ধীরে ধীরে মালদার মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে বহু গ্রাম। ক্রমশই বেড়ে চলছে সঙ্কট-জনিত বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা।  তাই কলকাতায় বসে কবিরা বর্ষা বন্দনায় মেতে উঠেলেও মালদার গঙ্গা তীরের বাসিন্দারা বর্ষার সময় প্রথম ফোটা কদম ফুল দেখেও কবিতার বদলে আশংকার প্রহর গোনেন।

ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক । কাজী কামাল নাসের,  ভারতীয় সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা অনুষদ (নয়া দিল্লী) প্রদত্ত গবেষণা প্রকল্পের ক্ষেত্র সমীক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর