জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ!

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 15:41:19

পরিস্থিতি এখন জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সর্বোচ্চ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি। চারিদিকে মৃত্যুর নগ্নপদ মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। এরই মধ্যে ছড়িয়েছে ডেঙ্গু এবং মরছে মানুষ। শুক্রবার (৯ জুলাই) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজিব জুস ফ্যাক্টরিতে এক লহমার আগুনে ঝলসে মারা গেছে অর্ধ শতাধিক মানুষ।  কামরাঙ্গীরচরে অটোরিক্সার ব্যাটারি বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছেন একই পরিবারের পাঁচ জন। এইসব দৈনিক পরিসংখ্যার সঙ্গে আছে সড়কে মৃত্যুর স্ফীত মাসিক হিসাব। আছে নারী ও শিশু নির্যাতনের লম্বা বহর।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বই যেন কম্পমান জীবন ও মৃত্যুর ঘোরতর সন্ধিক্ষণে। সঙ্কুল পরিস্থিতিতে সঙ্কটময় জীবনের প্রতিটি ক্ষণ।শুক্রবার (৯ জুলাই) প্রকাশিত ‘দ্য হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বিশ্বে করোনায় রোজ যত মানুষ মারা যাচ্ছে, এর চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে ক্ষুধায়। করোনায় যেখানে মিনিটে ৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে সেখানে ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে ১১ জন। মানুষ মারা যাচ্ছে যুদ্ধে, সংঘর্ষে, আততায়ীর অদৃশ্য খঞ্জরে। যেন মৃত্যুর প্রহর গ্রাস করেছে জীবনের ভূগোল।

দেড় বছরের চলমান প্রকোপের জেরে বাংলাদেশেও হু হু করে বাড়ছে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ২৯ তম এবং এশিয়ায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। এশিয়ায় বাংলাদেশের আগে রয়েছে কেবল ভারত, তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ইরাক।

বাংলাদেশে নতুন করে করোনায় শনাক্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৩২৪ জন। এর মধ্য দিয়ে সরকারি হিসেবেই এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৫৪৩ জন। আর এর মধ্য দিয়ে নতুন আরেকটি মাইলফলক অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। যদিও সেটা ইতিবাচক কিছু নয়। নিজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১০ লাখের বেশি আক্রান্ত হওয়া দেশগুলোর ক্লাবে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়া আর মাত্র ২৮ টি দেশ এ তালিকায় রয়েছে।

এদিকে, বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ ৩০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনায় মোট শনাক্তের সংখ্যা ১৮ কোটি ৬৪ লাখ ৯১ হাজার ৯৮৩। এদের মধ্যে ৪০ লাখ ২৯ হাজার ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার ৯১২ জন।

বাংলাদেশে করোনায় রোগি শনাক্তের ঊর্ধ্বগতিতে প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল করা হবে বলেও জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে। তদুপরি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো ও জনবল পুনর্বণ্টন করার বিষয়ও রয়েছে সক্রিয় বিবেচনায়।

সঙ্কট চলছে ভ্যাকসিন নিয়েও। বিশ্বের সকল দেশ সমান পরিমাণে এবং যথাসময়ে ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি আর ভ্যাকসিন পলিটিক্সে নাকাল উন্নয়নশীল দেশগুলোর গরিব মানুষ। করোনার নতুন নতুন ধরনের বিরুদ্ধে বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে দোলাচল। বলা হচ্ছে, একটি নয়, দু'টি নয়। করোনার সঙ্গে লড়াই করতে এবার লাগবে ভ্যাকসিনের ৩টি ডোজ। এমনটাই জানাচ্ছে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থা Pfizer-BioNTech. ডেল্টা সহ করোনার একাধিক নয়া প্রজাতির মোকাবিলায় এই সংস্থার তৈরি কমিরন্যাটি (Comirnaty) ভ্যাকসিনটির (Covid 19 Vaccine) তিনটি ডোজ প্রয়োজন বলে মনে করছে প্রস্তুতকারী সংস্থা। একটি বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, সাউথ আফ্রিকা এবং ভারতে পাওয়া করোনার প্রজাতি রুখতে এই ভ্যাকসিনের তিন নম্বর ডোজ কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই করোনার সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউকে ঘিরে শঙ্কা বাড়ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কাটিয়ে বিশ্বের অনেক দেশই সুস্থতার পথে হাঁটছে। তবে মারণ ভাইরাসের হাত থেকে রেহাই যে এখনই মিলছে না তা বুঝিয়ে দিয়েছে করোনার ডেল্টা প্রজাতি। তৃতীয় ঢেউ ঘিরে যখন উদ্বেগে সকলে, তখন চিন্তা বাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে করোনার এই প্রজাতি। এদিকে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ কমায় অনেক দেশই কোভিড নিয়ন্ত্রণে কড়া বিধিনিষেধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এই সিদ্ধান্তেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই মুহূর্তে কিছুতেই যাতে বিধিনিষেধ আলগা না করা হয়, সে ব্যাপারে বার্তা দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমার্জেন্সি প্রোগ্রাম হেড মাইকেল রায়ান।

করোনা বিষয়ক সামগ্রিক পরিস্থিতি আসলেই অনিশ্চতার বার্তাবহ। একের পর এক আসছে নতুন ঢেউ। দেখা দিচ্ছে  ভাইরাসের নতুন ধরন। সর্বত্র ঘোষিত হচ্ছে বিপদের পূর্বাভাষ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে জীবন ও মৃত্যুর এমন কঠিন সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি খুব কমই হয়েছে মানুষ। অতীতের অনেকগুলো মহামারি আর একাধিক যুদ্ধ-বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করেনাভাইরাসের চলমান তাণ্ডব। বিশ্বের এ যাবতকালের বিপদের সন্ধিক্ষণ নিয়ে গবেষণা করে  'Crossroad' নামে পুরস্কার বিজয়ী গ্রন্থ রচনা করেছিলেন মার্ক ডোনাল্ডসন (Mark Donaldson)। প্রতিদিন পুরোন রেকর্ড ভেঙে মৃত্যু ও আক্রান্তের নতুন নতুন রেকর্ড সেইসব বিপদের সন্ধিক্ষণকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে। চলমান সঙ্কটের লেলিহান বিপদ মানুষ আর পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে জীবন ও মৃত্যুর অভাবনীয় সঙ্কুল-সন্ধিক্ষণের মৃত্যু নীল উপত্যকায়। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর