ভাইয়া, কিছু টাকা দিবেন?

, ফিচার

আনিসুর বুলবুল | 2023-08-30 05:32:36

'ভাইয়া, কিছু টাকা দিবেন?'

কণ্ঠটা কানে আসতেই রিকশা থেকে ফিরে তাকাই। কালো রঙের ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা তার। চোখটা ছল ছল করছে। কোলে দেড় কি দুই বছরের শিশু। খুবই মিষ্টি। রিকশাচালককে থামতে বলি। তরুণী হেটে কাছে আসেন। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তার কোলের বাচ্চা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার হাতে থাকা শবরি কলার ছড়া থেকে একটি কলা ছিড়ে দিই। বাচ্চাটি কলার খোসা খুলে খেতে থাকে। তরুণীর তখনও মাথা নিচু।

মাটিকাটা বাজার থেকে সকালে কাঁচা বাজার করে ফিরছি। আমি মানি ব্যাগ বের করে দেখি ভাংতি টাকা খুব একটা নেই। পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিই। রিকশাচালক ফের পেডেলে পা চালায়।

বাজার এলাকায় সাধারণত যারা টাকার জন্য হাত পাতেন; তারা কাছে এসে চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকেন; না দেয়া পর্যন্ত চাইতেই থাকেন। আমার কৌতুহলী মনে প্রশ্ন জাগে; সাহায্য চেয়ে মাটির দিকে কেন তাকাবে?

চেক পোস্টের কাছে এসে রিকশাচালককে রিকশা ঘুরাতে বলি। ঘুরে বাজারের প্রবেশমুখ বরাবর গিয়েই দেখতে পাই তাদের। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বাচ্চাটির কলা খাওয়া শেষ। রিকশা নিয়েই তার কাছে যাই। আমি আরেকটি কলা ছিড়ে দিই।

'বাসা কোথায় আপনার? আপনাকে দেখে তো ফকির-মিসকিন মনে হয় না।'

তরুণী খুবই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আমার ফিরে যাওয়া দেখে নাকি আমার কথা শুনে বুঝতে পারি না। তখনও তার মাথা নিচু। অন্য দিকে সরে যেতে চায়।

'আপনার বাচ্চার টপস্‌টি সুন্দর। যারা ভিক্ষে করে তাদের বাচ্চাদের গায়ে এতো সুন্দর টপস্ থাকে না।'

তরুণী এবার খুবই ইতস্তত বোধ করছে। আমি আমার পরিচয় দিয়ে তাকে সহজ হতে সাহায্য করি।

'ভাইয়া, খুব সমস্যায় পড়েছি। বাড়িভাড়া দিতে গিয়ে হাত খালি হয়ে গেছে। আজ চাল কেনার টাকা নেই।'

তরুণী জানান, একটা মোবাইল ফোনের শো-রুমের সেল্স গার্ল হিসেবে কাজ করতেন। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে শো-রুম বন্ধ থাকায় বেতনও পাননি। বাচ্চার বাবা রিকশাভ্যানে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করে। তারও বেচা-কেনা বন্ধ।

'সামনে ঈদ। হাতে যে টাকা ছিলো সব টাকা দিয়েই বেচার জন্য পোশাক কিনেছে বাচ্চার বাবা। তার ওপর ধারও করেছে কিছু। সে তো টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাত তো কখনো পাতি নাই; খুবই লজ্জা লাগছে ভাইয়া।'

এবার আমার মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি শবরি কলার পুরো ছড়িটাই দিয়ে আসি বাচ্চাটির হাতে।

যারা একেবারেই প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ তাদের জীবনে মান-অপমানের জায়গা নাই। তাদের পেটের খিদেটাই বড়। তারা লাইনে দাঁড়াতেও পারেন, মানুষের কাছে হাতও পাততে পারেন। কিন্তু নিম্ম-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সামাজিক মর্যাদা ও লজ্জায় তা পারেন না।

করোনায় ভালো নেই এসব নিম্ম-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের খেটে খাওয়া মানুষ। এদের কাছে এখন করোনা নয়, খিদেই বড় আতঙ্কের নাম। এ আতঙ্কে লাজ-শরম ভেঙে ওই তরুণী নেমেছেন রাস্তায়।

আমরা আসলেই কি ভালো আছি? আমরা কজনের খবর রাখছি? আমাদের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তদের একটাই সমস্যা। আমরা না পারি হাত পাততে; না পারি হাত মারতে! জীবিকা নিয়ে সংকটে থাকা এসব মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না।

অসহায় মানুষ কাঁদছে, আসুন, মানুষের পাশে দাঁড়াই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর