অতিমারির কলকাতায় ঈদের স্মৃতিময়তা

, ফিচার

সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতা থেকে | 2023-09-01 12:00:52

"তোমার মনের মন্দিরে

আর তোমার মনের মসজিদে
আমি কথা দিয়ে এসেছি বারবার।"

কলকাতায় ঈদে এটাই থিমসং, সম্প্রীতির চিরায়ত প্রতিচিত্র। ঈদের কেনাকাটা, জমজমাট বাজার, প্রতিবেশীকে শেমাই পাঠানো জানান দিয়ে যেত ঈদ এসে গেছে।

কলকাতার তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেও ঈদের কেনাকাটা উপলক্ষে হুলুস্থুল পড়ে যেত। 'বিগ বাজার' বা 'মোরে'র মতো নামজাদা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে ব্যানার, হোর্ডিং এ ছাড়ের ঘোষণা, রাজাবাজার কিংবা বড়বাজারে হরেক সামগ্রী নিয়ে ঈদের আগের চাঁদরাতের মধ্যরাত্রি পর্যন্ত পসরা সাজিয়ে বসে থাকা, এগুলোই ছিল ঈদের আগের পরিচিত ছবি।

তারসঙ্গে ঈদের দিন সকালে ময়দানের অলিন্দে রেড রোডের নামাজ এবং সেই নামাজের পর একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন, কোলাকুলি, কুশল বিনিময়, এই সবগুলোই কলকাতাবাসীর অভ্যাসে ছিল ছিল তিলেত্তমার বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বর্ণালীর মতো।

কিন্তু করোনাকালে অতিমারির এই পৃথিবী সবকিছুকে বদলে দিয়েছে। ঈদের আগের দিন, মঙ্গলবারেও (২০ জুলাই), আমার কর্মস্থল কলকাতা সেন্ট্রাল বিসনেস ডিস্ট্রিক্টের ডালহৌসি স্কোয়ার লাগোয়া বড়বাজারে নজর দিয়ে দেখেছি, সেখানে অবস্থিত কলকাতার প্রধান মসজিদ, নাখোদা মসজিদের আশপাশের এলাকায় সেইরকম বাজার বসেনি।

বড়বাজার-চিৎপুরের রাস্তা ধরে লালবাজার থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত হেঁটে গেলে মনেই হবে না এটা ঈদের আগের দিনের কলকাতা। সেই ভিড় নেই, উচ্ছ্বাস নেই। কোলাহল আর মানুষের ভিড় একেবারেই নেই।

কলকাতার রেড রোডে ঐতিহ্যবাহী ঈদ নামাজ এখন স্মৃতি। সংগৃহীত

দক্ষিণ ২৪ পরগণার উস্তির বাসিন্দা কাজী আবদুল্লাহ ক্যানিং স্ট্রিট থেকে টুকটাক বাজার সেরে বাড়ি ফেরার সময় অনেক বেশি ভাবছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ ধাক্কা দিলে আবার বিধিনিষেধ বাড়বে না তো! বড়বাজারের অধিকাংশ দোকানিরই গোমড়া মুখ। ঈদের সময়ও তাঁদের বিক্রিবাটার হাল ফেরেনি।

প্রতিদিনের কাজের শেষে যথারীতি সোমবার রাতেও যখন রাজাবাজার দিয়ে বাড়ি ফিরেছি, মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে থাকা বাজার উধাও। দক্ষিণ ভারতের হায়দারাবাদের মতোই পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার এইসব মুসলিম মহল্লায় ঈদের আগের কয়েকদিন মধ্যরাত পর্যন্ত বাজার, কেনাকাটা এবং টুকটাক খাওয়াদাওয়া ছিল শতাব্দী প্রাচীন বাগরুক অভ্যাস।

কিন্তু এই অতিমারির পৃথিবী সবকিছুকে বদলে দিয়েছে। জমায়েত না করার নির্দেশ মেনেই রেড রোডে বুধবার কলকাতার প্রধান ঈদ নামাজের ঐতিহ্যবাহী জামায়াত হচ্ছে না। গোটা শহরেই কোথাও সেই উৎসবের মেজাজ নেই। কলকাতার বড় মলগুলো খুলে গেলেও প্রত্যাশিত ভিড়ের ছিঁটেফোঁটা পর্যন্ত নেই। ঈদের দিন বুধবার (২১ জুলাই) শহরের রেস্তোরাগুলোতেও পুরনো রেওয়াজ মেনে কতটা উৎসাহীরা আসবেন, সেই নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

কলকাতার নামকরা মোগলাই বা বিরিয়ানির চেন রেস্তোরার মালিকদের অবশ্য ধারণা, 'সুইগি' বা 'জোম্যাটো'র মতো ফুড অ্যাপ)-এর দৌলতে হোম ডেলিভারির মাধ্যমেই ঈদের উৎসব আমেজে বেশ বেশি বিক্রি হবে। করোনাকালে অবশ্য সেটাই দস্তুর। তাই ইদের দিনে 'আউধ ১৫৯০' বা 'সিরাজ', 'আমিনিয়া' বা 'আরসালান'-এর বিরিয়ানি কিংবা ফিরনি যাঁদের জন্য মাস্ট, তাঁরা হয়তো স্মার্ট ফোনে স্মার্ট অর্ডারই দেবেন।

কলকাতায় এইরকম একটা ম্যাড়মেরে ঈদের উদযাপন যদি মুসলিম মনকে বিষন্ন করে দেয়, তাহলে হিন্দু ব্যবসায়ীরাও কপাল চাপড়াচ্ছেন। শহরের কেন্দ্রস্থলে, বৌবাজারের ছানা পট্টিতে পনিরের পাশাপাশি খোয়া ক্ষিরের রমরমা কারবার চলে। সেই পনির ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, ঈদের সময়টায় প্রতি বছর এক একজন অন্তত ১০০ কেজি খোয়া ক্ষির বেচতেন। কিন্তু গত দুবছরে ১০ কিলো বিক্রি হওয়াটাও মুশকিল। প্রবীণ ব্যবসায়ী প্রশান্ত ঘোষ আলাপকালে বলছিলেন, আগে কোথা থেকে কোথা থেকে লোকে এসে ক্ষির নিয়ে যেতেন। অর্ডার অনুযায়ী মাল দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেতেন। কিন্তু ২০২০ থেকে সবই 'কাকস্য পরিবেদনা'। ব্যবসার হাল, বাস্তবে বেহাল! বড়বাজারের বিভিন্ন গলিতে চক্কর মেরে ব্যবসায়ীদের মুখ-ভার বিষন্নতার ছবি দেখতে দেখতে আমার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার বইয়ের নামটা মনে পড়ে গেল, 'সুন্দরের মন খারাপ, মাধূর্যের জ্বর'।

কলকাতা নামের এই প্রাচীন-ঐতিহ্যবাহী বঙ্গীয় শহরে মুসলিম আর হিন্দুর সম্পর্কটা আসলেই ওইরকম। একজনের বিষন্নতা অন্যজনের শরীরে জ্বর এনে দেয়। ভেদ-বিভেদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি আর সামাজিক কুসংস্কারের বিধি ছিন্ন করে এই শহরের অনেক-অনেক নীলরঙা আকাশ মৈত্রী ও ভালোবাসার সবুজ চাদরে জড়িয়ে রাখে সবাইকে।

সর্বশেষ: কলকাতার খিলাফত কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, করোনার কারণে রেড রোডে এবারও ঈদুল আজহার নামাজ হবে না। প্রায় তিনলাখ মুসলিম সমাগত হতেন এই নামাজে। নারকেলডাঙায় পশুর হাট এবার শুনশান। ভেড়া কিংবা গরু এবার আসেনি পশুর হাটে। করোনার কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে পশুর হাট। বড়বাজার-জাকারিয়া স্ট্রিটে নেই দুম্বা। সারদিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হয়ে আসা উটের সারিও চোখে পড়ে নি। এবার কোরবানিই কম তাই মাংস বিতরণের প্রশ্নই ওঠেনা। যদিও হোটেল রেস্তোরাঁর দরজা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে খুলছে, কিন্তু স্মৃতি-উদ্বেলিত ঈদ উৎসবের সেই উদযাপন কোথায়?

লেখক: সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর