এই বর্ষায় দুর্লভ ‘কালোমাথা কাস্তেচরা’দের প্রজননমৌসুম

, ফিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-08-31 22:24:01

প্রকৃতি এখন বর্ষামূখর। বলা নেই, কও নেই – হুট করে নেমে আসে বৃষ্টি। থেমে থেমে চলতে থাকা থেকে শুরু করে চলে বিরামহীন অবস্থা পর্যন্ত। প্রকৃতিতে রবিশস্যের উর্বরতা দান করে এই মহা উপকারী বৃষ্টি। তাই তো এই বৃষ্টিকেই রবীন্দ্রনাথ বর্ষামঙ্গল বলে প্রতি বছর তার প্রাণের শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল উৎসবের আয়োজন করতেন। প্রকৃতির এই প্রাণবৈচিত্র্যকে আবৃত্তি, সঙ্গীত ও নৃত্যে সম্মাননা জানাতেন।

বলছিলাম প্রকৃতিতে প্রাণদানের কথা। শুধু রবিশস্যকে কেন, বর্ষা উদ্ভিদকূল এবং প্রাণিকূলের সর্বত্রই জাগায় প্রাণের বার্তা। বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় প্রাণিকূলের প্রতিনিধিরা খুঁজে পায় প্রেমের শিহরণ। পাখিরাও এর থেকে বঞ্চিত নয়। বিশেষত জলাভূমি কেন্দ্রিক পাখিরা এ সময় মিলনপিয়াসী হয়ে উঠে। প্রিয়কে বা প্রিয়াকে কাছে পাবার জন্য তারা ব্যাকুল হয়।

এ ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এই সারস জাতীয় দূর্লভ প্রজাতির পাখিটিও। বাইক্কা বিলে বর্ষায় তারা প্রাণোচ্ছ্বাস ফিরে পায়। শরীরের শিরা-উপশিরায় আসে নবযৌবনের বার্তা।

এ পাখিটির শরীরের প্রায় সবই সাদা। তবে চারটি বিশেষ শারীরিক স্থান বাদে। দূর থেকে সাদা রঙ সর্বপ্রথম ফুটে উঠে। হাওরের ধূষর জলজপ্রকৃতির মাঝে এই দু’টি রঙের সংমিশ্রণ দৃষ্টি কাঁড়ে। তাকাতে মন চায় বারবার।

লম্বা ঠোঁট কাঁদায় গুজে খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত ওরা। ছবি- সাঈদ বিন জামাল

লম্বা ঠোঁট কাঁদায় গুজে খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত ওরা। ছবি- সাঈদ বিন জামাল

বাইক্কা বিলের শীত মৌসুমেও অন্য জলচর পাখিদের মতো এ পাখিটিকে সচরাচর দেখা যায় না। বাংলাদেশে এ পাখিটি ‘দুলর্ভ পাখি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত।

বাইক্কাবিল পাখিপর্যবেক্ষণ টাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক মিরাস মিয়া কয়েক বছর আগে দূরবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে এই পাখিটিকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলেন। ‘বহু বছর পর দেখলাম’ বলে প্রাপ্তির হাসি হাসলেন। সেই থেকে পাখিটির সাথে পরিচয়।

সেদিন দূরবীক্ষণযন্ত্রে চোখ রাখতেই দেখা যায় কাঁদায় মুখগুজে খাবার অনুসন্ধানে ব্যস্ত। পাশের পাখিটি সকৌতুকে ধেয়ে এসে তাড়া করছে একে অপরকে। পরিযায়ী পাখিদের ভিড়ে এই পাখিটিকে দেখে হৃদয় জুড়ায়।

প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, ‘কালোমাথা কাস্তেচরা’ পাখিটি জলাভূমি, নদী, প্লাবিত তৃণভূমি, ধানক্ষেত, কাঁদাচরা, জোয়ারভাটার খাঁড়ি ও উপকূলে বিচরণ করে। উড়ার সময় এরা বকের মতো গলা ভাজ করে না। শীতের আবাসে সম্পূর্ণ নীরব থাকে; কিন্তু গ্রীষ্মে বাসায় বসে শুকরের মতো নাকিসূরে ‘খোঁত’ ‘খোঁত’ শব্দে ডাকতে থাকে।

প্রজনন মৌসুমে এরা পানির ধারে আংশিক জলমগ্ন বৃক্ষে কিংবা গ্রামীণ কুঞ্জবনে ছোট ডালপালা দিয়ে মাচার মতো বাসা বানিয়ে ডিম পড়ে বলে জানান ইনাম আল হক।

কালো পা দিয়ে ওরা জলাভূমির কাঁদায় হেঁটে বেড়ায়। ছবি- সাঈদ বিন জামাল

কালো পা দিয়ে ওরা জলাভূমির কাঁদায় হেঁটে বেড়ায়। ছবি- সাঈদ বিন জামাল

বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী সাঈদ বিন জামাল বলেন, পরিযায়ী ‘কালোমাথা কাস্তেচরা’ বর্তমানে বাংলাদেশের বিরলপ্রায় প্রজাতি। একে ‘কাঁচিচোরা’ও বলে। ইংরেজি নাম Black-headed Ibis এবং বৈজ্ঞানিক নাম Threskiornis melanocephalus। সাধারণত ছোট থেকে মাঝারি ঝাঁকে বাস করে। এখন আমাদের দেশে বড় ঝাঁকে দেখা যায় না। এই ছবিগুলো বাইক্কা বিল থেকে তোলা হয়েছে।

এর প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, সুন্দরবন থেকে শুভলং এবং টেকনাফ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর যেখানে বড় বড় জলাশয়, বিল, হাওর এবং নদীর চর ও মোহনা-উপকূলীয় এলাকায় অল্পবিস্তর কাস্তেচরা দেখা যায়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

এদের শারীরিক গঠন ও খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন, এ জলচর পাখিটির দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭৫ সেন্টিমিটার এবং ঠোঁট ২০ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় এক কেজির কাছাকাছি। লম্বাগলা, পা ও ঠোঁটের অধিকারী পাখিদের মধ্যে কাস্তেচরার রং পুরো সাদা। কেবল গলা থেকে ঠোঁট কালো এবং ঠোঁট লম্বা এবং নিচে বাঁকানো। পানিতে হেঁটে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করে। প্রধান খাদ্য পোকামাকড়, কেঁচো, ছোট মাছ, ব্যাঙ ও অন্যান্য ছোট জলজপ্রাণী। বর্ষা এদের প্রজনন ঋতু।

আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য গবেষণা ও সংরক্ষণ সংস্থা ‘আইইউসিএন’ এর অনুসারে এরা Near Threatened প্রজাতি। জলাভূমির পরিবেশ ধ্বংস এবং অবাধে শিকার এদেরকে আমাদের দেশে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানান সাঈদ বিন জামাল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর