উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যময় লেক ডিস্ট্রিক্ট

, ফিচার

সাঈদ চৌধুরী | 2023-09-01 22:59:51

লেক ডিস্ট্রিক্ট মানেই হৃদ আর সবুজ ছায়াঘেরা মনোরম পর্বতমালায় হারিয়ে যাওয়া। যেখানে রয়েছে ইংল্যান্ডের গভীরতম হ্রদ এবং সর্বোচ্চ পর্বত, বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী জাতীয় উদ্যান, সুরম্য উপত্যকা ও বিস্তীর্ণ বালুকাময় উপকূলরেখা। জুলাই মাসে গিয়েছিলাম সেখানে। প্রকৃতি প্রেমী শত শত মানুষের পদচারণায় ছিল মুখরিত। উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের স্নিগ্ধ মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হৃদয় ছুঁয়েছে।

দেশ-বিদেশের মানুষের অন্যতম জনপ্রিয় বিরতির জায়গা এই লেক ডিস্ট্রিক্ট। সাধারণত লকল্যান্ড নামেই অভিহিত। ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম কোণে কুমারিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। স্কটিশ সীমান্তের ঠিক নীচের অংশ। অর্ধ শতাধিক হ্রদ আর পাহাড় ঘেরা নয়নাভিরাম দৃশ্য। এই মৌসুমে মানুষের ঢল নামে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক লীলাভূমির পিকনিক ও পর্যটন স্পটগুলোতে। নিবিড় ঘন গাছপালায় সমৃদ্ধ পুরো অঞ্চল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ন্যাশনাল পার্ক। 


লেক ডিস্ট্রিক্টে উইন্ডারমেয়ার (WINDERMERE) হল ইংল্যান্ডের বৃহত্তম হ্রদ। এটি সাড়ে ১০ মাইল দীর্ঘ। এছাড়া অনিস্টন ওয়াটার পাঁচ মাইল লম্বা এবং আধ মাইল চওড়া। এখানকার কনিস্টন নৌকা কেন্দ্র থেকে অত্যাধুনিক ইঞ্জিন নৌকা এবং বাইক ভাড়া নেয়া যায়। শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে স্থানীয় হ্রদ কেসউইক। হ্রদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া ফ্রায়ার ক্র্যাগের দুর্দান্ত ভিউ পয়েন্ট। এটি বোরোডেল উপত্যকার প্রবেশদ্বার। চতুর পাশেই রয়েছে উল্লেখযোগ্য হলিডে কটেজ।

লেক ডিস্ট্রিক্টের সবচেয়ে সুবিধাজনক হ্রদটি হল, এম-৬ পেনরিথ জংশন থেকে ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে অবস্থিত। পর্বতমালা এবং ময়দানের চমৎকার দৃশ্যগুলি অপূর্ব। ছোট ছোট হ্রদগুলির মধ্যে একটি বুটমেইর। দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা অঞ্চল। পাশেই রয়েছে ওয়েস্ট মোরিল্ল্যান্ড গ্রিন স্লেট হস্টিস্ট। স্লেট খনি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। আপরদিকে আছে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের গ্রাম গ্রাসমেয়ার এবং গ্রাসমেয়ার ওয়াটার। 


ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার মতই তার জন্মভূমি। নিঃসর্গের মাঝে যেন রোমান্টিসিজমের আবহ। ১৮ শতকের শেষের দিকে রোমান্টিকতা সাহিত্য প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে ইউরোপে উদ্ভূত হয়েছিল। উইলিয়াম এই ধারার সফল প্রবর্তক। এখানকার জীবনাচরণ আর আবেগ-অনুভূতির নিগূঢ় রহস্য তার কবিতায় অসাধারণ মহিমা লাভ করেছে। আবেগ এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের পাশাপাশি প্রকৃতি ও আত্মার সাথে গভীর অনুভূতির প্রকাশ। রোমান্টিকতা ইংরেজি কবিতা এবং ছন্দবদ্ধ রচনার ইতিহাসে বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার প্রেরণা এই লেক ডিস্ট্রিক্ট। দুনিয়ার লেখক-সাহিত্যিকদের কাছে তাই জায়গাটি বিখ্যাত। আধুনিক রোমান্টিসিজমের অনন্য কবি উইলিয়াম। তার কবিতা ইংরেজি সাহিত্যকে বিপুলভাবে সম্পদশালী করেছে। প্রকৃতিকে অসাধারণ মহিমায় সাজিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সাহিত্যে যার অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ রাজসভার কবি উইলিয়াম তার কাব্যে সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ, মানবিক বৈশিষ্ট্য এবং আবেগ-অনুভূতির কথা অত্যন্ত নান্দনিকতার সাথে তুলে ধরেছেন। তবে প্রকৃতির কবি হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত।


উত্তর ইংল্যান্ডের ককারমাউথ গ্রাসমেয়ারে ১৭৭০ সালের ৭ এপ্রিল উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের জন্ম। জন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও অ্যান বুকসনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ছেলে বেলায় বাবার কাছে মিলটন, শেক্সপিয়র ও স্পেনসারের কবিতা শিখেছেন। তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৭৯১ সালে। তারও আগে ১৭৮৭ সালে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম সনেট প্রকাশিত হয় ‘দি ইউরোপিয়ান’ ম্যাগাজিনে। এরপর তিনি ওয়াচম্যান নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তখন ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের সাথে পরিচয় ঘটে। কোলরিজের অনুপ্রেরণায় ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত হয় তাদের যৌথ কাব্য LYRICAL BALLADS। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয় তার কবিতা।

নিচের অসাধারণ পঙক্তিমালা থেকে অনুধাবন করা যায় কবি কীভাবে প্রকৃতি অন্বেষণ করতেন। ‘FIVE YEARS HAVE PASSED; FIVE SUMMERS, WITH THE LENGTH / OF FIVE LONG WINTERS! AND AGAIN I HEAR / THESE WATERS, ROLLING FROM THEIR MOUNTAIN SPRINGS / WITH A SOFT INLAND MURMUR. ONCE AGAIN / DO I BEHOLD THESE STEEP AND LOFTY CLIFFS, / WHICH ON A WILD SECLUDED SCENE IMPRESS / THOUGHTS OF MORE DEEP SECLUSION, AND CONNECT / THE LANDSCAPE WITH THE QUIET OF THE SKY.‘ (Lines Composed a Few Miles above Tintern Abbey, On Revisiting the Banks of the Wye during a Tour. July 13, 1798, By William Wordsworth).


তবে TINTERN ABBEY উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সর্বাধিক বিখ্যাত কবিতা, এটি ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। কথোপকথনের মধ্য দিয়ে নাটকীয় একাত্ত্বিক উপাদান সমৃদ্ধ। কবিতাটি ওয়াই নদীর ওয়েলশ তীরে মনমাউথশায়ারের টিনটার্ন গ্রামে অবস্থিত একটি ছোট জায়গার উপর ভিত্তি করে। এই কবিতার মাধ্যমে কবি তার পাঠকদের প্রকৃতি এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে নিজস্ব দর্শন বুঝতে চেয়েছেন।

১৮০৭ সালে প্রকাশিত কবিতা SOLITARY REAPER পড়লে অন্যরকম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দেখা মিলে। একটি অল্পবয়সী মেয়েকে নিয়ে অপূর্ব গীতিনাট্য। গীতিকার এবং গানের সুর ও অভিব্যক্তি যে কোন পাঠক মন্ত্রমুগ্ধ হন। 

অবশ্য উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সবচেয়ে আলোচিত কবিতা হচ্ছে ‘THE PRELUDE OR, GROWTH OF A POET'S MIND; AN AUTOBIOGRAPHICAL POEM‘. এই কবিতার কেন্দ্রবিন্দু ও শৈলী থেকে বোঝা যায় নব্য-ক্ল্যাসিক্যাল ধারা থেকে কবিতাটি রোমান্টিক ধারার দিকে ঝুঁকেছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত একটি আত্মজীবনী মূলক কথোপকথন। ১৭৯৮ সালে ২৮ বছর বয়সে উইলিয়াম এই কবিতাটি রচনা শুরু করেন এবং সারা জীবন ধরে আপডেট করেছিলেন। তিনি এই কবিতার কোনো শিরোনাম দেননি। ১৮৫০ সালে তার মৃত্যুর তিন মাস পর প্রথম প্রকাশিত হয় এবং শিরোনামটি দেন তার স্ত্রী মেরি।    


লেক ডিস্ট্রিক্টের গ্রাসমেইর উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ির কাছে রয়েছে একটি ছোট দর্শনীয় লেক। সবাই একবার সেখানে যায়। তার উত্তর প্রান্তে ক্ষুদ্র গ্রাম উভয়। রোমান্টিক কবিদের কাছে সবচেয়ে বিখ্যাত। সেখানে রয়েছে ডোভ কুটির। যেখানে উইলিয়াম তার বোন ডোরোথি এবং স্ত্রী মেরি নিয়ে বেশিরভাগ বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন। আর এখানেই কবি সস্ত্রীক চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এখান থেকে অনতিদূরে রয়েছে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যাদুঘর। 

এক সময় অভিজাত ইংরেজ শিল্পপতিরা গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলি লেক ডিস্ট্রিকে কাটাতেন। ফলে তারা খুবই আকর্ষণীয় ডিজাইনের বাড়িঘর বানিয়েছেন। কয়েক শত বছর আগের এই সুবিশাল বাড়িগুলি এখন কটেজ, গেস্ট হাউস ও হোটেল হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।

বাড়ির আমেজে ছুটি কাটাতে কটেজ বেশ উপযোগী। লোকেশনের ওপর ভাড়া নির্ভর করে। উচু টিলা বা পাহাড়ের উপর বাড়িগুলি পর্যটকদের অধিক পছন্দ। আমাদের পারিবারিক ট্যুর ছিল। তাই হোটেলে না গিয়ে কটেজ নিয়েছিলাম। সে হিসেবে পূর্বের বুকিং দেয়া ছিল। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে ওঠা-নামা করতে হয়। বিশাল উচুতে মন ভুলানো কাঠের বাড়ি।

লেখক

এখানে পাহাড় ও আকাশের মধ্যে দূরত্বটা খুব কম মনে হয়। অভূতপূর্ব সৌন্দর্য দৃশ্য। কবির ভাষায় ‘ওপরে পর্বতের ঢেউরাশি গোধূলির বাঁকে। নিচে ঝরনার হাসি রংধনু বনের ফাঁকে।’

বিস্তীর্ণ বনভূমিতে আশপাশের পাহাড় ও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সবাই পুলকিত। কিন্তু বৃষ্টির সময় পাথর বাঁধানো আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু রাস্তা থেকে শিশুদের ছিটকে পড়ার ভয়ে মনটা শিহরিত হয়ে উঠে।

পাহাড়ের পাশে লেক বা নদী হলে মজাই আলাদা। আমরা যেখানে ছিলাম তার পাশে লেক সাইডে ভিক্টোরিয়ান স্টিমার রাখা আছে। মন চাইলেই ঘুরে বেড়ানো যায়। এখানকার পাহাড় হল একটি ভূমিরূপ, যা পার্শ্ববর্তী ভূখন্ডে প্রসারিত। নানা উচ্চতা থেকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত দেখা যায়। বিশেষ করে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর।

জায়গাটা ন্যাশনাল পার্কের ফ্রন্ট সাইট হওয়ায় দেশি-বিদেশি মুভির শুটিংও হয়। এখানে প্রধান ঝর্ণার উৎপত্তিস্থল। পাথরের গায়ে ছুটে চলা ঝর্ণার তুমুল গর্জনে আমরা বার বার অভিভূত হয়েছি। পাহাড়ের ঢালে সকলেই বাহারি ফুল আর মায়াবী গাছপালায়  ছবি তুলেছেন। গাড়ি দিয়ে যাবার সময় সেলফির ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়।

লেক ক্রজিংয়ের দিন ছোটদের আনন্দের সীমা ছিলনা। সকাল বেলা বৃষ্টি দেখে মনটা খারাপ হয়েছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্য ঝলমল আকাশ দেখে তারা হেসে উঠল। সারা দিন ইঞ্জিন নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি মনে রাখার মত। বৃহদাকার লেক দেখে সমুদ্রের মতো মনে হয়। তবে এই সমুদ্র প্রায় সরোবরের মতো শান্ত। বিভিন্ন স্থানে নৌকা বাধার ঘাট ও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। সাথে সাথে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম আপডেট তো আছেই।

প্রাতঃরাশ সেরেই রোদচশমা চোখে সবুজ পাহাড়ের কোলে বেরিয়ে পড়তাম। নির্মল বাতাসে হালকা রঙের পোশাকে দৌড়াতে খুব ভাল লাগে। হাসি-আড্ডা, মজা-মাস্তি আর ঘোরাঘুরি। ফুর্তির মেজাজে গোটা এলাকা। স্যুভেনিয়র শপে টুকিটাকি উপহার কেনাকাটার প্রয়াস লক্ষণীয়। কাফেতে জমিয়ে পানাহার চলছে। ফিস এ্যান্ড চিপসের  দোকানে সবচেয়ে দীর্ঘ সাড়ি।

সবচেয়ে সমরণীয় ছিল ঘরের পাশে চমৎকার পাখির বাসা। যেন নানা প্রজাতির পাখির আশ্রয়কেন্দ্র। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে আমি বিহ্বল হয়ে পড়ি। ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে পাখির কোলাহলের কথা মনে পড়ে। এদের নিয়ে দীর্ঘ কবিতা লিখেছি।

লেক ডিস্ট্রিক্টে ঘুরে বেড়ানোর সময় উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ড্যাফোডিলস ফুলের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আজো সমানভাবে দৃশ্যমান। ১৮০৭ সালে লেখা কবিতার বঙ্গানুবাদ হল, ‘আমি মেঘের মত একাকী ঘুরে বেড়াই / মেঘ ভেসে যায় পাহাড় আর উপত্যকায় / আমি  তখন অবলোকন করি সমাবেশ / স্বর্ণালী ড্যাফোডিল শাখায় শাখায় পল্লবিত / লেকের পাশে, গাছের নিচে / মৃদুমন্দ বাতাসে নেচে নেচে দোল খায় / উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অবিরাম / ছায়াপথে আলো জ্বলজ্বল করে / সুবিন্যস্ত তারকারাজির সারি শেষ অবধি / দশ হাজার আমি এক নজরে দেখেছি / নৃত্যে মাথা নাড়ানোর স্বতঃস্ফুর্ত দৃশ্য / কিন্তু তারা উল্লাসে ঝলমলে / ঢেউগুলিও ছাড়িয়ে যাচ্ছে / এমন আমুদের সঙ্গ পাওয়া কবি / বিহ্বল না হয়ে পারে না / আমি শুধু ভাবলাম এবং তাকালাম / এই দৃশ্যের মাঝে কী সম্পদ রয়েছে যা আমার জন্য ছিল / প্রায়শ আমি যখন শূন্যমনে / চিন্তিত মেজাজে / সোফায় শুয়ে থাকি ফুলগুলি আমাকে ঝলকানি দেয় / নির্জনতার আনন্দে / আমার হৃদয় ভরে যায় / নেচে ওঠে ড্যাফোডিলের সাথে।’ (I WANDERED LONELY AS A CLOUD BY WILLIAM WORDSWORTH)

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সময় সম্পাদক, কবি ও কথাশিল্পী

এ সম্পর্কিত আরও খবর