মানুষের খুব কাছাকাছি বাস করে উপকারী লক্ষ্মীপেঁচা। পুরাতন গাছের কোটরে, পুরাতন মঠ-মন্দির বা দালান, বাড়ির কার্নিস বা গোপনীয় কোণা, দালানের ভেন্টিলেটারের ভাঙা অংশ প্রভৃতি জায়গাগুলোতেই স্বস্তিতে বসবাস করতে দেখা যায় তাদের।
এক সময় সেই জায়গাগুলোতে তারা ডিম পাড়ে। কিন্তু প্রজনন মৌসুসে সেই সব জায়গায় ডিম ফুটে বাচ্চা তোলার পরই ঘটে যত প্রকারের বিপত্তি। লক্ষ্মীপেঁচার ছানাদের এমন অবাক করা মুখ বা ব্যতিক্রমী চেহারা দেখে অনেকেই ভয় পেয়ে যায়। মুখ চ্যাপ্টা হওয়াতে লোকে লক্ষ্মীপেচাকে অন্যপ্রাণী মনে করে নানাভাবে আহত করে থাকে।
ভাবতে থাকেন এ অবার কোন অবাক প্রাণী! এক জোড়া বা তিন কিংবা চারটা ছানায় থাকে একেকটি বাসায়। সেই ‘ভয়’ এমনি ভয়াবহ যে অনেক ক্ষেত্রে প্রাণে মরতেও হয় মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী এই প্রাণীটিকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী গবেষক ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘বর্তমানে লক্ষ্মীপেঁচারা হুমকির মুখে। বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমের পরে ছানাগুলোকে বড় করতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখিসহ অনেক ক্ষেত্রে প্রাণেও মরে তারা।’
এর কারণটা হলো, এরা দেখতে একটু অন্যরকম। বিশেষ করে তাদের মুখে যে আকৃতি; এটার কারণেই এই প্রাণীটিকে অনেক না চিনে অনেক ভয় পেয়ে আমাদের বলেন যে, ‘কী যেন একটা পাখি মতো দেখতে।...’ অনেক জায়গা থেকে আমরা এভাবেই লক্ষ্মীপেঁচার ছানাদের রেসকিউ (উদ্ধার) করে নিয়ে এসেছি।
তিনি আরো বলেন, এর প্রধান খাবারই হলো ইঁদুর। এ কারণেই এরা আমাদের বাড়িঘরের আশপাশে থাকে। গাছের কোটরে অথবা বিল্ডিংএর কার্নিসগুলোতে। দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে এবং সন্ধ্যায় বের হয়। এরা কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ইঁদুর খায়। আমাদের ক্যাম্পাসে এগুলো রয়েছে মোটামুটিভাবে পরিমাণে।
এক ঘটনা উল্লেখ করে এই বন্যপ্রাণী-গবেষক বলেন, একদিন এক মালিকে দেখি লক্ষ্মীপেঁচাকে মারছে। পরে আমরা তার কাছে গিয়ে এর জানতে চাইলাম। সে বললো, ‘এই বিচিত্র প্রাণীটি নাকি সব পাখি খেয়ে শেষ করে ফেলছে।’ পরে সে আমাদের বিল্ডিংএর কার্নিসে নিয়ে দেখালো লক্ষ্মীপেঁচার বাসায় অনেকগুলো হাঁড়-মাথা পড়ে আছে। তারপর আমরা সেখান থেকে সেই হাঁড়-মাথাগুলো আমরা নামালাম এবং মালির ভুল ভাঙিয়ে বললাম, এই দেখো এগুলো সবই ইঁদুরের মাথা এবং ইঁদুরের হাঁড়। তারপর মালির ভুল ভাঙে।
ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে ওরা আমাদে পরিবেশের অত্যন্ত উপকার সাধন করে করে থাকে। আমরা আমাদের ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টার (বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্র) থেকে যত প্রাণী এ পর্যন্ত উদ্ধার করেছি তার বেশির ভাগই হলো এই লক্ষ্মীপেঁচা এবং তাদের ছানা। এরা দেখতে একটু অন্যরকম হওয়াতে বিশেষ করে মুখটা চ্যাপ্টা হওয়াতে লোকজন এ প্রাণীটিকে কি না কি ভাবে। তবে এরা অত্যন্ত নিহির এবং মানুষ ও পরিবেশের উপকারী প্রাণী ড. কামরুল হাসান।
ড. কামরুল হাসান উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ধামরাই থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের ফোন করে বলেন যে, আমাদের বাড়ির কার্নিসে পাখি মতো দেখতে কয়েকটা জিনিস দেখা যাচ্ছে। এগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে যান; তা না হলে আমরা তাদের মেরে ফেলবো।’ পরে আমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি ওগুলো লক্ষ্মীপেঁচার ছানা। পরে ওগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে ছেড়ে দিই।
লক্ষ্মীপেঁচার ইংরেজী নাম Common Barn Owl এবং বৈজ্ঞানিক নাম Tyto alba। এর আকারে কবুতরের মতো। ৩৬ সেন্টিমিটার। হালকা সোনালী পিঠ এবং সাদাটে পেট। এদের মুখমন্ডলটা হার্ট সেইপের। অর্থাৎ দেখতে হৃদাকৃতির। কাছে গিয়ে দেখলে বা ছবিটা জুম করে দেখলে চোখ আর ঠোঁটটা অধিকরত ফুটে ওঠে বলে জানান প্রফেসর ড. কামরুল হাসান।