ইলিশের বাড়িতে একদিন

, ফিচার

নিউজ ডেস্ক, বার্তা ২৪ | 2023-09-01 08:43:05

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। এই প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে বহুকাল থেকে বাঙালির ইলিশ প্রীতির কথা সুবিদিত। শর্ষে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ দোপেয়াজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ভাজা, ভাপা ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, দই ইলিশ, ইলিশের টক, ইলিশের মালাইকারী, ইলিশের ভর্তা -এমন নানা পদের খাবার বাংলাদেশে জনপ্রিয়।

 

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ।

 

পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। ... সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ। পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় যে ধরনের খাবার খায় ইলিশ, এবং পানির প্রবাহের যে মাত্রা তার ফলে এর শরীরে উৎপন্ন হওয়া চর্বিই এর স্বাদ অন্য যেকোন জায়গার ইলিশের চেয়ে ভিন্ন করেছে।

 

 সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আলাদা ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সেইসঙ্গে স্বীকৃত পণ্য আছে। সে হিসাবে চাঁদপুর জেলা ব্যাপকভাবে সমাদৃত ইলিশ উৎপাদনের জন্য। এজন্য এই জেলাকে 'ইলিশের বাড়ি' বলা হয়ে থাকে।

 

চাঁদপুর জেলাকে 'ইলিশের বাড়ি' বলা হয়ে থাকে।

 

২০১৫ সালে চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর মণ্ডল ইলিশের ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন । চাঁদপুর জেলাকে 'ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর' নামে ব্র্যান্ডিং করেন তিনি। এর দুই বছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকেও পরে এই দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

 

'ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর' - ২০১৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

 

দেশের ৩০ শতাংশ ইলিশ চাঁদপুর থেকে আহরণ করা হয়। তাছাড়া ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালিসহ অন্যান্য কয়েকটি জেলায় আহরণ করা সব ইলিশ আগে আনা হয় চাঁদপুরের বাজারে। এখান থেকেই সারা দেশে মাছ সরবরাহ করা হয়। দেশের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় অর্ধেক এই বাজারগুলো থেকেই সারা দেশে পাঠানো হয়।

 

দেশের ৩০ শতাংশ ইলিশ চাঁদপুর থেকে আহরণ করা হয়।

 

ইলিশ আদতে সাগরেরই মাছ। তবে নাইওরে তাকে আসতে হয় কুল রক্ষার জন্য ডিম পেড়ে জাটকা ফুটানোর তাগিদে। প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরত্বের এক লম্বা সফরে উপমহাদেশের নদীতে পাড়ি জমায় ইলিশ। বাংলাদেশের ভেতরে সে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে আসে।

 

ইলিশ আদতে সাগরেরই মাছ।

 

নদীর ইলিশ একটু বেঁটেখাটো হবে, আর সাগরের ইলিশ হবে সরু ও লম্বা। সেই সঙ্গে নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ চকচকে বেশি হবে, বেশি রুপালী হবে রং। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার হবে পটলের মতো অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা হতে হবে।

 

নদীর ইলিশ চকচকে বেশি হবে, বেশি রুপালী হবে রং।

 

ভোজন রসিকেরা মনে করেন, নদীর ইলিশ আর সাগরের ইলিশের মধ্যে স্বাদে অনেক পার্থক্য আছে। তবে খাদ্য বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন ইলিশের সব ধরনই স্বাদের। ইলিশ মাছ আকারে যত বড় হবে, তত তার স্বাদ বেশি হয়।

 

 ইলিশ মাছ আকারে যত বড় হবে, তত তার স্বাদ বেশি হয়।

 

সমুদ্র থেকে ইলিশ নদীতে ঢোকার পরে নদীর উজানে মানে স্রোতের বিপরীতে যখন চলে, সেসময় এদের শরীরে ফ্যাট বা চর্বি জমা হয়। এই ফ্যাট বা তেলের জন্যই ইলিশের স্বাদ হয়। বর্ষাকালে পাওয়া ইলিশের স্বাদ বেশি হয়। বর্ষার মাঝামাঝি যখন, ইলশে গুড়ি বৃষ্টি হয়, সেই সময়ে নদীতে পাওয়া ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে বেশি।

 

বর্ষাকালে পাওয়া ইলিশের স্বাদ বেশি হয়।

 

লোনা পানি ও মিঠা পানিতে বসবাসের কারণেও ইলিশের স্বাদে কিছুটা পার্থক্য হয়। আর সেক্ষেত্রে নদীর ইলিশের স্বাদই বেশি হয়। এছাড়া ডিম ছাড়ার আগ পর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে। ডিমওয়ালা ইলিশে মাছের পেটি পাতলা হয়ে যায়, এবং চর্বি কমে যায় ... এ কারণে স্বাদ কমে যায়।

 

ডিম ছাড়ার আগ পর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে।

 

সাধারণত অগাস্ট মাসের পর থেকে শুরু হয় ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, চলবে সেপ্টেম্বর অক্টোবর পর্যন্ত। তবে এখন তো বারোমাস বাজারে ইলিশ পাওয়া যায়। ডিমওয়ালা ইলিশের পেটমোটা হবে এবং এটা চ্যাপ্টা হয়ে থাকে। ডিমওয়ালা ইলিশের পেট টিপলেই মাছের পায়ুর ছিদ্র দিয়ে ডিম বেরিয়ে আসবে। আর ডিম ছাড়া মাছের পেট আলগা বা ঢিলা থাকবে।

 

ডিমওয়ালা ইলিশের পেটমোটা হবে এবং এটা চ্যাপ্টা হয়ে থাকে।

 

উপমহাদেশের সেরা ইলিশ মেলে বাংলাদেশের পদ্মা (গঙ্গার কিছু অংশ), মেঘনা (ব্রহ্মপুত্রের কিছু অংশ) এবং দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী নদীতে। দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও এই মাছ পাওয়া যায়। সেখানে ইলিশকে 'পাল্লা' নামে ডাকা হয়। এই মাছ খুব অল্প পরিমাণে থাট্টা জেলাতেও মিলত। বর্তমানে সিন্ধু নদের জলস্তর নেমে যাওয়ার কারণে পাল্লা বা ইলিশ আর দেখা যায় না।

 

উপমহাদেশের সেরা ইলিশ মেলে বাংলাদেশের পদ্মায় ...।

 

ইলিশের খ্যাতি এর স্বাদের জন্যই। ফলে ছোট ইলিশ বা জাটকা কখনোই কেনা উচিত নয়। কারণ ওগুলোর স্বাদ হয় না। ইলিশ যদি দীর্ঘদিন কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে এর স্বাদ কমে যায়। এটা চিনতে হলে খেয়াল রাখতে হবে এই মাছের ঔজ্জ্বল্য কম থাকবে। এছাড়া একটু নরম মাছ দেখলে বুঝবেন সেটা কয়েকদিন আগের আনা বাসি মাছ।

 

ইলিশের খ্যাতি এর স্বাদের জন্যই।

 

স্বাদে অনন্য ইলিশ পুষ্টিগুণেও ভরপুর। ইলিশ মাছে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম। এই মাছ খেলে হৃদযন্ত্র ভালো থাকে, মস্তিষ্কের গঠন ভালো হয়, রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাক, এবং বাত বা আর্থারাইটিস কম হয়। ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারও কম হয়।

 

স্বাদে অনন্য ইলিশ পুষ্টিগুণেও ভরপুর।

 

সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে ইলিশ খাওয়ার অভ্যাস। নিয়মিত মাছ খেলে অ্যাকজিমা, সিরোসিসের হাত থেকে রক্ষা পায় ত্বক। ইলিশ মাছে থাকা প্রোটিন কোলাজেনের অন্যতম উপাদান। এই কোলাজেন ত্বক টাইট ও নমনীয় রাখতে সাহায্য করে। ইলিশ মাছের মধ্যে থাকা ভিটামিন এ রাতকানা রোগের মোকাবিলা করতেও সাহায্য করে।

 

সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে ইলিশ খাওয়ার অভ্যাস।

 

জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। আর এই মৌসুমকে ঘিরে সব সময় চাঁদপুর শহরের প্রধান মৎস্য কেন্দ্র তথা বড়স্টেশন ইলিশের আড়ৎ থাকে সরগরম। প্রতিদিন অন্তত ২০০ আড়তদার ও মাছ ব্যবসায়ীর ঘরে অন্যান্য মাছ ছাড়াও পাঁচশ থেকে এক হাজার মণ ইলিশ কেনাবেচা হয়ে থাকে।

 

জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম।

 

ইলিশ মাছকে বার্মিজ ভাষায় বলা হয় না-থা-লোক, না-থালাংক। হিন্দিতে বলা হয় হিলসা, পালা। অসমিয়া ভাষায় বলা হয় ইলিহি। তেলুগু ভাষায় বলা হয় পালাসা, পালাসাহ, পালিয়া, পোলাসা। গুজরাটি ভাষায় বলা হয় চাকশি, চাকসি, চাসকি, পাল্লা। মালয়ালাম ভাষায় বলা হয় পালিয়াহ, পালুভা, ভালাভা। পাঞ্জাবি ভাষায় ইলিশকে পাল্লা এবং উর্দুতে পালো ও পুল্লা বলা হয়।

 

ইলিশ মাছকে বার্মিজ ভাষায় বলা হয় না-থা-লোক, না-থালাংক।

 

যুক্তরাষ্ট্রে বৈশ্বিক নাম হিলসা বলেই ডাকা হয়। যুক্তরাজ্যে বলা হয় হিলসা হেরিং। ভিয়েতনামে ক্যা কে বলা হয় ইলিশকে। পোলান্ডে পলিশ ভাষায় বলা হয় হিলজা ইনডিজস্কা। পর্তুগালে পর্তুগিজ ভাষায় ইলিশকে বলা হয় পালা। চেক ভাষায় ইলিশের নাম প্লাককা ইলিশা, স্লেড পালাসাহ। ডেনমার্কে ইলিশের নাম হিলসা-স্টামস্লিড। 

 

যুক্তরাষ্ট্রে বৈশ্বিক নাম হিলসা বলেই ডাকা হয়।

 

সূত্র: গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর