ধলাই নদের বুকে সাদা পাথর-পাহাড়-জলের প্রেম!

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 20:00:31

টলটলে স্বচ্ছ নীল জলরাশি। উপরে শরতের শুভ্র মেঘে ঢাকা নীলাম্বরী। উঁচু পাহাড়ে সবুজের মায়াজাল! ঘটঘট শব্দ করে ইঞ্চিন নৌকা ভিড়ে ধু-ধু বালু চরে। অদূরেই প্রতিবেশি পাহাড়ের পাদদেশে সাদা কাঁশফুলের হাতছানি। সাদা পাথরের বিছানা দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা শীতল ঝরনা। যা মিশে যাচ্ছে ধলাই নদের উৎস মুখে। সাদা পাথর, উঁচু পাহাড় আর ধলাইয়ের স্বচ্ছ নীল জলরাশি মিলে যেন এক নৈসর্গিক প্রেমময় মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে! 

সাদা পাথর, উঁচু পাহাড় আর ধলাইয়ের স্বচ্ছ নীল জলরাশি ... 

সিলেটকে ৩৬০ পীর-আউলিয়ার দেশ বলা হয়। মাজার-মসজিদ নানা স্থাপনা রয়েছে এখানে। আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্যেও ভরা সিলেট বিভাগ। চা-বাগান, জলমগ্ন বুনো বন, পাথুরে নদী, পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা ঝরনা, দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি হাওরসহ পুরো বিভাগে জুড়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সব পর্যটনকেন্দ্র। এরমধ্যে নয়নাভিরাম ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। সিলেট শহর পার হলেই চোঁখ ধাঁধানো সবুজের হাতছানি। যাত্রার সঙ্গী হয় ছোট-বড় টিলার মতো পাহাড়গুলোকে মুড়িয়ে রাখা চা-বাগান, নীলাকাশ, সবুজ ক্ষেত, ছোট-বড় নদী খাল। 

সিলেট শহর পার হলেই চোঁখ ধাঁধানো সবুজের হাতছানি।

শহরের আম্বরখানা থেকে দো-তলা বিআরটিসি বাসে করে সাদা পাথরকে আলিঙ্গন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিআরটিসি বাসের দো-তলায় সবার পছন্দ, অবশ্য এ সিট বরাদ্দ হয়- আগে আসা ও বসার ভিত্তিতে। এখানে বলে রাখা ভালো বিআরটিসি ছাড়াও সাদা পাথর নামে আরেকটি পরিবহন রয়েছে। ৬০ টাকা বিনিময়ে ৫০ মিনিটেই ধলাইয়ের উৎসমুখ সাদা পাথরে। কেউ চাইলে রির্জাভ সিএনজি অটোরিকশাতেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খরচ গুণতে হবে বেশি। 

সকালের কড়া রোদে যাত্রা।

সকালের কড়া রোদে যাত্রা। প্রচণ্ড গরম, বাসের ভেতরে সিটের সামনে ফ্যান দেখে আরাম লাগে। তবে সিটে বসেই মনটাই খারাপ হয়; সবার ফ্যান ভনভন করে ঘুরলেও আমারটা নষ্ট। আর তা দেখে একজন বলেই ফেললেন, ‘আপনার কপালটা মন্দ’। যদিও বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরতের স্নিগ্ধ প্রকৃতি হিমেল হাওয়া দিয়ে যাত্রা আরামদায়ক করে।

শরতের মেঘে ঢাকা নীলাম্বরী

মসৃণ সড়কপথ, মাঝে মাঝে ধুলোর ঝাপটা কিছুটা বিতৃষ্ণা আনে। সিলেট সদর পার হয়েই কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় ঢুকলেই দেখা যায়- পথের দুই ধারে পাথরের স্তুপ। কোথাও কোথাও মেশিনে পাথর ভাঙার ব্যস্ততা। আর এ পাথরের উৎস ধলাই নদ। ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর পাথর ঝরনার পানিতে নেমে আসে। স্থানীয় বাসিন্দাদের এই পাথরেই জীবকার অন্যতম উৎস। 

সঙ্গী হয় ছোট-বড় টিলার মতো পাহাড়গুলোকে মুড়িয়ে রাখা চা-বাগান, নীলাকাশ

ভোলাগঞ্জ বাজার পেরিয়ে এক কিলোমিটারের মধ্যেই সাদা পাথরে যাওয়ার ঘাট। ঘাটে নামলেই মনোরম দৃশ্যে চোঁখ তাতিয়ে উঠবে। যেন প্রথম দেখাতেই প্রেম! মায়াময় এ দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করতে ছটফট করবে মন। যদিও সামনে অপেক্ষা করছে অপার সৌন্দর্য! ঘাটের মুখে ছোট-বড় বেশ কিছু দোকান রয়েছে। পর্যটকদের জন্য পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। 

শীতল জলে পা ডুবিয়ে আনমনে পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকার, কিছু বলার!

চায়ের দেশে চা পান করে, চাঙ্গা হলাম। সিলেটে আসার পর থেকে প্রতিবার চায়ে চুমুক দিলে আলাদা একটা স্বাদ পাচ্ছি। যদিও আমার সফর সঙ্গীর দাবি, এখন পর্যন্ত চায়ের আলাদা কোন চা পেলাম না। তার পর্যবেক্ষণের আত্মবিশ্বাস দেখে চা নিয়ে আমার ধারণা ‘ভ্রম’ মনে হতে শুরু করেছে।

ধলাইয়ের তীরে রয়েছে সারি সারি নৌকা। সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৮০০ টাকা দিয়ে ধলাই পার হয়ে সাদা পাথরে। নৌকাগুলো উঠায় যায় ৮-১০ জন। নৌকায় একজন গেলেও ভাড়া ৮০০ টাকা। 

ভরা বর্ষায় টইটুম্বুর ধলাই পেরিয়ে সাদা পাথর যেন স্বর্গরাজ্য।

ভরা বর্ষায় টইটুম্বুর ধলাই পেরিয়ে সাদা পাথর যেন স্বর্গরাজ্য। এখন পানি কম থাকায় নৌকা থেকে নেমে পা পড়বে বালুচরে। বালুচরে ঘোড়া সওয়ারের ব্যবস্থাও রয়েছে। তপ্ত রোদে পোড়া বালুপথ শেষে চোখে পড়বে পাথর রাজ্য। পাথর বিছানো বিছানার উপর দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে ঝরনার পানি। দুই দিকে পাথর, মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলধারা। শীতল জলধারায় পা দিলেই প্রশান্তি ছুঁয়ে যাবে। আর এই পানিতে টায়ার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন বয়সী পর্যটকরা। ঘণ্টার পার ঘণ্টা চলে তাদের জলকেলি। জলে শান্ত করে মন-প্রাণ।

জলধারা পার হয়ে পাহাড়ের রাজ্য ও কাঁশফুলের দোলা। পাথরের ওপর পা রেখে ধেয়ে আসা হাঁটু পানির জলাধার পার হওয়া কিন্তু কম কষ্ট সাধ্য না-রীতিমতো ব্যথা দেবে পাথরগুলো। 

সাদা মেঘ বেষ্টিত পাহাড়গুলোর কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই।

সাদা মেঘ বেষ্টিত পাহাড়গুলোর কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই পিছনে রেখে চলে ফ্রেমবন্দী। কারণ ওগুলো প্রতিবেশি দেশের সম্পত্তি। অর্থাৎ ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। তাই দুই দেশের সীমান্ত বাহিনী বিজিবি-বিএসএফের বিশেষ নজরদারি।

নৌকা ছুটছে পাহাড়েরর আলিঙ্গনে

দুই ঘণ্টায় সাদা পাথরের অপরূপ মোহনীয় সৌন্দর্যের সঙ্গে আমার চূড়ান্ত প্রেম হলো। যদিও বিকাল চারটার মধ্যে সিলেট শহরে পৌঁছানোর তাড়া থাকায় খুব অল্প সময়েই বিদায় দিতে হলো। খুব ইচ্ছে ছিল আরো কিছুক্ষণ জল-পাথর-পাহাড়ের সান্নিধ্যে থাকার। শীতল জলে পা ডুবিয়ে আনমনে পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকার, কিছু বলার! তাই বিদায়বেলায় আক্ষেপের সুরে পঙ্কজ উদাসের গানটাই মনে পড়ল- 'যদি আরেকটু সময় পেতাম ... '।

এ সম্পর্কিত আরও খবর