রাস পূর্ণিমা: প্রেমরসে সিক্ত চাঁদের গল্প

, ফিচার

অসীম নন্দন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম | 2023-09-01 19:14:44

রাতের খাবার খেয়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছি। হেমন্তের হিমেল বাতাসে শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। আর আকাশে উঠেছে তখন রাস পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের স্বচ্ছ মায়াবী আলোয় বিশ্বচরাচর সিক্ত হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের কবি-লেখকেরা যুগে যুগে এই চাঁদের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন কত-শত অপূর্ব সাহিত্যকর্ম; তার কোনো হিসেব আমরা জানি না!

এই মায়াবী চাঁদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই কখনো বিশ্বকবি রবিঠাকুর বলে গেছেন, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার, গন্ধসুধা ঢালো।’ আবার কখনো রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলে গেছেন, ‘বেবিলন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো; চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!’

আর কখনো সকল রোমান্টিকতাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে কঠিন বাস্তবতার নিরিখে কবি সুকান্ত বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়, পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

চাঁদের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলাম। তখনই মনে পড়লো, আমার বাড়ির থেকে ৫/৭ মিনিটের হাঁটা-পথের দূরত্বেই রাস-উৎসব হচ্ছে। ভাবলাম হাঁটিহাঁটি পা-পা করে একটু দেখেই আসি। চলে গেলাম মধুপুরের ‘মদন গোপাল আঙিনায়’। টাংগাইলের মধুপুর উপজেলায় ‘শ্রী শ্রী মদন গোপাল বিগ্রহ মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২৯৮ বঙ্গাব্দে। প্রায় ১৩০ বছর পুরানো এই মন্দির। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজশাহী জেলার পুঠিয়া নিবাসী মহারাণী শ্রীমতী হেমন্ত কুমারী দেবী।

প্রতি বছরই এই মন্দিরে রাস-উৎসব পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি বৈষ্ণব মতাদর্শীদের প্রাণের উৎসব এই রাসপূর্ণিমা। এছাড়া মণিপুরীদের প্রধান উৎসব এই রাসপূর্ণিমা। মন্দিরে গিয়ে দেখি লীলা-কীর্তন হচ্ছে। একদল কীর্তনীয়া লীলা-কীর্তন গাইছে আর ভক্তেরা শ্রীকৃষ্ণের সেই লীলা'র মহিমা ভক্তিভাবে গানে গানে সুরে সুরে শুনছে।


কীর্তন শেষে অনুষ্ঠিত হলো রাধাকৃষ্ণের পূজা। পূজা শেষে দেখলাম, ভক্তরা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে। বিগ্রহটা মূলত রাধাকৃষ্ণ এবং গোপিনীদের মাটির মূর্তি দিয়ে তৈরি। রাধাকৃষ্ণের মূর্তিকে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে গোপিনীদের মূর্তি। আর এই পুরো বিগ্রহটি একটা চাকাযুক্ত চক্রাকার কাঠামোতে উপবিষ্ট করা। যাকে সহজেই চক্রাকারে ঘোরানো যায়।

গোপিনী সংবলিত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে এইভাবে চক্রাকারে ঘোরানোর মাঝেই রাসলীলার মাহাত্ম্য নিহিত। সবশেষে প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটলো।

রাসপূর্ণিমা'র মাহাত্ম্য:
পদ্মপুরাণে শারদরাস এবং বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বাসন্তীরাসের উল্লেখ থাকলেও শারদরাসের উল্লেখ নেই। শারদরাসের কথা বলা আছে শ্রীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে। শারদরাস মূলত কার্তিক মাসের শেষ পূর্ণিমাতে পালন করা হয়। বস্ত্রহরণের দিন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গোপিনীদের কথা দিয়েছিলেন, পরবর্তী পূর্ণিমা-তিথিতে তিনি গোপিনীদের সাথে রাস-উৎসব করবেন।

কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে গোপিনীরা সংসারের কর্তব্যজ্ঞান ভুলে বৃন্দাবনে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে নিজেদেরকে নিবেদন করেছিল। কৃষ্ণ তাদেরকে বারবার স্ব-গৃহে ফিরে যেতে বললেও, গোপিনীবৃন্দ সেই অনুরোধ মানে নাই।

গোপিনীদের একমাত্র কামনা ছিল শ্রীকৃষ্ণকে একান্তে নিভৃতে পাওয়া। তাদের বিশেষ ভক্তি আর অনুরোধে কৃষ্ণ তাদের নিকটে এলেই তারা ভাবছিল, কানাই শুধু তার একার। যখনই এরকম ভাবছিল তখনই কৃষ্ণ তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। আর গোপিনীরা গভীর বিরহে কাতর হচ্ছিল। ভগবান কারো একার সম্পত্তি নয়। ঈশ্বর সকলের। এই সারকথা বোঝানোর জন্যই কৃষ্ণ এই রাসলীলা করেছিলেন।


গোপিনীরা ভক্তিভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যখন শ্রীকৃষ্ণের এই সারকথা অনুধাবন করতে পারলো, তখন তিনি 'যতজন গোপিনী ততজন কৃষ্ণ' রূপে সকলের সাথে রাসনৃত্য করলেন। রাস-উৎসব মূলত জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের কথা। এটি দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় রূপায়িত করার উৎসব। মানুষের কামপ্রবৃত্তিগুলোকে প্রেমসূচক করে তোলার উৎসব এই রাসপূর্ণিমা।

কীভাবে শুরু হলো এই উৎসব?:
জনশ্রুতি আছে, বৈষ্ণব মতাদর্শের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যদেবের হাত ধরেই এই উৎসব প্রথম শুরু হয়। সেই দিক থেকে দেখলে ১৬ শতকের দিকে এই উৎসব নবদ্বীপে পালিত হওয়া শুরু হয়। যদিও চৈতন্যদেবের পরবর্তী সময়ে নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় ধারার চক্র-রাস উৎসব পালন একটু ফিঁকে হয়ে যায়। এবং চক্ররাসের পরিবর্তে শাক্ত-রাস উৎসবের সূচনা ঘটে। শাক্ত-রাস মূলত মদ-মাংস এবং আড়ম্বরপূর্ণ জৌলুস সমৃদ্ধ উৎসব।

প্রধানত যেসব জায়গায় রাস-উৎসব পালিত হয়:
ভারতের মথুরা, বৃন্দাবন, নবদ্বীপ, নদীয়ার শান্তিপুরে এই উৎসব খুব ধুমধামের সাথে পালন করে ভক্তরা। এটাকে মূলত শান্তিপুরের ভঙ্গারাস বলা হয়ে থাকে। এছাড়া ওড়িশা, আসাম এবং মনিপুরে এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে অঞ্চলভেদে কথ্থক, ভারতনাট্যম, ওড়িশি, মণিপুরি প্রভৃতি শাস্ত্রীয় ও লোকায়ত নৃত্যসুষমার ব্যবহার দেখা যায়।

নবদ্বীপে শাক্তরাস খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়ে থাকে। এখানে রাধাকৃষ্ণ ছাড়াও সকল দেবদেবীরই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব। এখানে এই উৎসবকে ঘিরে নির্মিত হয় চমৎকার সব মূর্তি। অপরূপ কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী এবং বিচিত্র রূপকল্পে নানান শক্তিরূপের নির্মিত মূর্তিকে পূজা করার মধ্য দিয়েই এই উৎসব নবদ্বীপে পালিত। এছাড়া নবদ্বীপের কোথাও কোথাও অনাড়ম্বরভাবে চক্র-রাসও পালিত হয়।

আগেই বলেছি, এটি মণিপুরিদের সবচেয়ে বড় উৎসব। কথিত আছে, আঠারো শতকের দিকে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বাংলাদেশে এই উৎসবের প্রথম প্রচলন করেন। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডপে প্রতি বছর এই উৎসব বিরাট কলেবরে পালিত হয়। লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে এই উৎসবে।

এইদিন কৃষ্ণের বিগ্রহকে ঘিরে কুমারী মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। ১৭৭৯ খ্রীস্টাব্দের দিকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নৃত্যগীতের সমন্বয়ে এই উৎসবের প্রচলন ঘটান মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র। ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে রাসনৃত্যকে আচৌকা, বৃন্দাবন, খুড়ুম্বা, গোস্ট, গোস্ট বৃন্দাবন ইত্যাদি ভঙ্গিমায় মণিপুরিদের মাঝে রাসনৃত্য ছড়িয়ে দেন।

রাসলীলা উৎসব শুরু হয় মূলত গোষ্ঠলীলা থেকে। গোষ্ঠলীলায় ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা গোপালের মতন রাখাল সেজে গোষ্ঠনৃত্য করে এবং গরু চড়াতে যায়। পাশাপাশি চলতে থাকে মণিপুরিদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসব। মণিপুরি সমাজে রাসনৃত্য ছয় ভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো মহারাস, নিত্যরাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, গোপীরাস ও উদুখলরাস।

এবং সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস উপলক্ষে ভক্তদের জন্য তীর্থ-স্নানের আয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতের বাঙালি অধ্যুসিত বিভিন্ন অঞ্চলে এই রাস-উৎসব পালন করা হয়।

রাধাকৃষ্ণ হচ্ছে সেই নাম যাঁদের সাথে অমর প্রেমকাহিনী জড়িয়ে আছে। তখনও রোমিও-জুলিয়েটের প্রেমকাহিনী মানুষের কাছে পৌঁছায় নাই। আর সেই মধ্যযুগ থেকেই এই প্রেমকাহিনী বাঙলার মানুষের হৃদয়ের গল্প হয়ে আছে। আমাদের বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে তাদের শৈল্পিক ভাষা আর ছন্দে করে তুলেছেন অমর।


ভক্তিবাদীরা আর বৈষ্ণব মতাদর্শের মানুষেরা রাধাকৃষ্ণকে ঈশ্বরের সিংহাসন থেকে নামিয়ে নিজেদের ঘরের আসনে রক্তমাংসের মানুষের মতন প্রেমের-প্রতীক হিসাবে স্থান দিয়েছে। আমাদের বাংলাসাহিত্যের অন্যতম সোনালী যুগ হচ্ছে বৈষ্ণব-পদাবলীর যুগ। বৈষ্ণব-পদাবলীর মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি মহাকালের মহান মহান কবিদের। যাঁরা ভক্তিভাবে প্রেমের কথা বলে গেছেন যুগের পর যুগ ধরে।

কবি বৃন্দাবন দাস'র একটি পদের কথা এইখানে বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছিলেন; কৃষ্ণ রাধাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘শুন রাধে এই রস আমি যে তোমার বশ, তোমা বিনে নাহি লয় মনে। জপিতে তোমার নাম ধৈরয না ধরে প্রাণ, তুয়া রূপ করিয়ে ধেয়ানে।’ গল্প বলতে শুরু করেছিলাম পূর্ণিমার চাঁদকে নিয়ে, কথা বলতে বলতে নিতাই-চাঁদের গল্পে এসে থামলাম।

চাঁদের গল্প বলতে গেলে তো প্রেম আসবেই। যুগে যুগে রোমান্টিকতার কথায় যখনই চাঁদ এসেছে তখনই তো প্রেমের কথাও উঠেছে। ভবা পাগলার সেই গানের কথা মনে পড়ছে। মনসুর ফকির সুন্দর করে গেয়েছিলেন-‘আমার নিতাই চাঁদের বাজারে, গৌর চাঁদের দরবারে, একমন যার সেই যেতে পারে। ও ভাই সেই যেতে পারে।’

প্রেম তো তাই, যা একমনে একপ্রাণে করতে হয়। কায়মনোবাক্যে নিষ্কামভাবে প্রেমই তো মানুষকে শান্তি দেয়। জীবনের দিকে হাঁটতে আস্বস্ত করে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: শুভ্রা গোস্বামী

এ সম্পর্কিত আরও খবর