কিসের ওমিক্রন! এটা ঢাকা এয়ারপোর্ট!

, ফিচার

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা | 2023-09-01 22:06:03

ব্যাংককের সঙ্গে নিয়মিত ফ্লাইট হিসেবে সপ্তাহে দু’বার উড়ালের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। তার প্রথম ফ্লাইট ডিসেম্বরের ২ তারিখ, বৃহস্পতিবার। প্রথম ফ্লাইটের যাত্রী আমি। বেলা তখন প্রায় ১ টা। বিমানের ভেতর সিট বেল্ট লাগিয়ে বসে আছি গত ১ ঘণ্টা ধরে, বিমানের কোন নড়চড় নেই। এরই মধ্যে ককপিট থেকে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে এক নারী কণ্ঠ ভেসে আসলো। জানানো হলো, কোভিডের পর ব্যাংকক রুটের প্রথম ফ্লাইটের যাত্রী হিসেবে আমাদের উপহার দেয়া হবে। বোঝা যাচ্ছিল, এসব কথা বলে যাত্রীদের একটি স্বস্তি দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছিলেন ভদ্রমহিলা। তবে যাত্রীদের মধ্যে কোন উৎসাহ দেখা গেলো না।

উৎসাহ না থাকার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। যেমন আমার পাশের যাত্রী নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে বের হয়েছেন সকাল ৬ টায়। ৭ ঘণ্টা পরেও তিনি উড়তে পারেননি। প্রতিষ্ঠার পর গত ৪১ বছর ধরে একটি রানওয়ে নিয়ে চলা বিমানবন্দর থেকে ওড়া মাঝে মাঝেই ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ওই একটি রানওয়েতেই বিমান উড্ডয়ন, অবতরণ, জরুরি অবতরণ, সব হয়। আজ বিমানবাহিনীর একটি বিমানের জরুরি অবতরণ হওয়ায় এই দেরি হচ্ছে বলে জানালেন পাইলট।

barta24

বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) সকাল ৮টায় যখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালাম, তখনই বোঝা হয়ে গিয়েছিল দিনটা আজ হয়রানি আর ক্লান্তিতে ভর করবে। বিমানবন্দরে প্রবেশের প্রথম সড়কেই গাড়ি থেকে যাত্রী ছাড়া অন্যদের বের করে দেয়া হচ্ছে। গাড়ির চেয়ে সিএনজিগুলোতে কেন জানি সন্দেহ বেশি! এটা যে নিয়মিত চিত্র তা নয়। এর পূর্বের রাতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বোমা রয়েছে সন্দেহে তল্লাসী চালানো হয়। তাই আজ একটু বেশি কড়াকড়ি। মেনে নিয়ে গেটের দিকে এগোলাম।

barta24

এয়ারপোর্টের বহির্গমন ফ্লোরে একটা বিষয় খেয়াল করবেন। ১ থেকে ৩ নং গেইটে ভিড় বেশি থাকে। এরপর ধীরে ধীরে ভিড় কমে। যেমন আমি দেখলাম এই তিনটি গেটে মানুষ প্রবেশের দীর্ঘ লাইন। আবার আমি ৫ নং গেট দিয়ে যখন প্রবেশ করি, সেটি প্রায় ফাঁকা। ভেতরে প্রবেশ করেই প্রথমে করোনার আরটি-পিসিআর টেস্টের ফলাফল চেক করার পালা। প্রতিটি গেটের পাশে দুটি করে বুথ। তবে চোখ কান খোলা না রাখলে এগুলোর কিছুই আপনি বুঝতে পারবেন না। কারণ ‘এয়ারপোর্টে করণীয়’ যেমন কোন সাইন নেই, তেমনি আপনাকে দেখিয়ে দেয়ার কোন লোকও নেই। এর মধ্যে প্রতি দুটি বুথের একটিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা নেই। তাই দীর্ঘ লাইন জমেছে সবখানেই। চেক করে সেখানে স্বাক্ষর করে দেন বিমানবন্দরের এসিসটেন্ট হেলথ অফিসার।

barta24

এরপর বাংলাদেশ বিমানের চেক-ইন কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, অনেকেই টিকেট হাতে অন্যদিকে ছুটছেন। আমিও ছুটলাম। এখানে আবার তিনটি কাউন্টার রয়েছে সকল কাগজপত্র চেক করার। এতো যাত্রীর সব কাগজ চেক করতে ডিসেম্বরের সকালেও ঘাম ঝড়ছে বিমানের কর্মকর্তাদের।

যে দেশে যেতে যেসব তথ্য প্রয়োজন, যাত্রীর কাছে সেগুলো রয়েছে কিনা, যাচাই করে ‘চেক’ সীল মেরে দেয়া হচ্ছে। এই কাউন্টারে একেবারে বাঘে-নেকড়েতে বাঁধলো কিছুক্ষণ পর। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একটি দল যাচ্ছে থাইল্যান্ডে। এর মধ্যে একজনের হাতে লাল, কূটনৈতিক পাসপোর্ট। আরেকজনের হাতে নীল সরকারি পাসপোর্ট। থাইল্যান্ডে প্রবেশের নতুন নিয়মানুযায়ী ৫০ হাজার ইউএস ডলারের হেলথ ইন্সুরেন্স এবং কোয়ারান্টাইনের জন্য হোটেল রিজার্ভেশন প্রয়োজন। এই দুজনের এসব নেই। বিমানের কর্মকর্তা যখন এগুলো চাইলেন, তাদের দুজনের উত্তর সবকিছু এম্বেসি ম্যানেজ করেছে, আপনে সীল দেন। এ নিয়ে বাক বিতণ্ডা। অবশ্য পরে লাল পাসপোর্টধারী জিতলেন এবং সীল দিতে বাধ্য হলেন চেকের জন্য দ্বায়িত্বে থাকা ব্যক্তি।

এই কাউন্টারে এসে খেয়াল করলাম, আমার সামনে লোক মাত্র ২ জন। কিন্তু তাদের হাতে পাসপোর্ট রয়েছে ৭ থেকে ১০ টি করে। সাদা পোশাক এবং কালো প্যান্টের এই ব্যক্তিদের প্রথমে আমার কাস্টমসের লোক মনে হলো। কিন্তু আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম আরো অনেক ব্যক্তি তাদের। বাংলাদেশে যখন প্রতি ৩ জনে একজন ভিআইপি, তখন এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণদের পাসপোর্ট হাতেই এরা দ্বায়িত্বরত মনে হলো।

পরে চেক ইন কাউন্টারেও দেখলাম এই ধরনের ব্যজ আর পোশাক পরা আরেক ব্যক্তির হাতে বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট। এরা লাইন অমান্য করে কাউন্টারে সরাসরি পাসপোর্টগুলো নিয়ে চলে যায়। খেয়াল করলাম, এদের গলায় ঝুলানো ফিতায় শাহজালাল আন্তর্জ াতিক বিমানবন্দরের ফাঁকে ফাঁকে ছোট করে লেখা রয়েছে ‘হেলপ লাইন লিমিটেড’।

এবার জানতে চাইলাম এমন একজনের কাছে।

আপনারা কি এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা নাকি বাংলাদেশ বিমানের?

এয়ারপোর্টের।

হেলপ লাইন লিমিটেডের লোক আপনেরা? আগেতো দেখি নাই!

আমরা সিভিল এভিয়েশনের অধীনে।

ও। আপনাদের নিয়োগ কি স্থায়ী?

না। চুক্তি ভিত্তিক।

এরপর আরো এক ঘণ্টার চেক ইন শেষে এই হেলপ লাইনের সহযোগিতা নেয়া ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলাম। আপনারা যে হেলপ পেলেন, কিভাবে এই হেলপ পাওয়া যায়?

উত্তরে বললেন, টাকা না দিলে, কি এসব পাওয়া যায়!

ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম এবার। আমার সামনে বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা দাড়িয়ে আছেন দীর্ঘ লাইনে। আমি বললাম, আপনারা বিশেষ কাউন্টারের জন্য যান। কারন সেখানে প্রায় ফাঁকা আর যারা দাঁড়িয়ে আছে, সবাইকে সুস্থ এবং তরুন মনে হচ্ছে।

ইমিগ্রেশনের লাইনে গাঁয়ে গা লেগে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। একজনের সীল মারা হলেই আরেকজন পাসপার্ট চেপে দিচ্ছে। পাশের এক যাত্রী বললেন, ওমিক্রনের কারণে নাকি অনেক এয়ারপোর্ট এখন কড়াকড়ি আরোপ করছে। দুবাইগামী একজন নিয়মিত যাত্রী প্রতি উত্তরে বললেন, কিসের ওমিক্রন! এটা ঢাকা এয়ারপোর্ট!

দুপুর তখন ২ টা ১০ মিনিট। আমাদের বিমানটি ধীরে ধীরে রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে। আড়াই ঘণ্টার বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। অবশেষে উড়াল দেবার অপেক্ষায় আমরা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর