জল ডুবুডুবু নীল দেশ মালদ্বীপ!

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 08:25:08

স্যান্ড ব্যাংক আইল্যান্ড, মালদ্বীপ ঘুরে: হয়ত ভ্রমণ উত্তেজনায় মালদ্বীপের দ্বিতীয় দিনে ঘুমটা সকাল সকালেই ভেঙে গেল। রাতটা কাটে কখনও গভীর ঘুমে কখনও আধো ঘুমে! জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই সকাল ছয়টাতেও কড়া রোদের ঝাপটা লাগল চোখে। পথঘাট দেখে বোঝা গেল শেষ রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছে মালদ্বীপ। তাই হুলুমালে দ্বীপ আরও চকচক করছে। 

ঝটপট রেডি হয়ে নাস্তা সেরে নিলাম! সকাল ৮টায় কোন এক আইল্যান্ডে যাওয়ার প্ল্যান। তখনও আইল্যান্ডের নাম জানতে পারিনি। সাংবাদিকদের বিশাল গ্রুপ নিয়ে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স এই ট্যুরের আয়োজন করেছে। গ্রুপটা বড় হওয়ায় সময় মেইনটেন্ট করতে কিছুটা এদিক-ওদিকে হয়ে যায়। তাই, এই ফাঁকে হুলু মালের হোয়াইট বিচে একটু চক্কর মারলাম।   

হুলু মালের হোয়াইট বিচ

হোয়াইট বিচের সাগরের পানি অতটা নীল না হলেও এর নৈসর্গিক দৃশ্য অতুলনীয়! সৈকতের চকচকে সাদা বালু, সাগরের তীরে নারিকেল গাছসহ পরিকল্পনা করে লাগানো গাছের সারি সবাইকে মুগ্ধ করবে।

স্থানীয় সময় সাড়ে ৯ টায় ডাক আসে আইল্যান্ডে যাত্রার। সাজানো গোছানো শহর হুলুমালের পথ-ঘাট পেরিয়ে জেটিতে পৌঁছাই। এরপরেই চক্ষু ছানাবড়া। সামনে অথৈ নীল সমুদ্র। তখনই মনে পড়ল গিরীন্দ্রনাথ দত্তের সমুদ্র দর্শন কবিতার ‘অনন্ত আকাশ উচে/ অনন্ত সাগর নীচে/ অনন্তে অনন্তে দেখ করে আলিঙ্গন।’ সেই কবিতার সঙ্গে আমিও নীল জলের লহরীতে নিজেকে সমর্পণ করলাম সারা দিনের জন্য!

হুলুমালে জেটি

জেটিতে সারি সারি স্পিড বোট, ফেরি ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। পিছনে সমুদ্র রেখে মোবাইলের ক্যামেরায় কয়েকটি ক্লিক করলাম। হুলুমালের এই জেটি থেকে স্পিড বোট, ফেরি ও ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে বিভিন্ন আইল্যান্ড ও রিসোর্টে যান পর্যটকরা। ইঞ্জিনচালিত বোটে করে সাগরের নীল মায়ার গালিছা মাড়িয়ে ছুটলাম স্যান্ড ব্যাংক আইল্যান্ডে! ঢেউয়ের তালে তালে ছুটছে বোট। বোটে উঠেই আমি গন্তব্য স্থলের নাম জানলাম। যদিও পূর্ব প্রস্ততি হিসেবে কাপড়-চোপড়ও সঙ্গে নিয়েছিলাম; যাতে করে অন্তত জলকেলি করা যায়। হুলু মালে থেকে স্যান্ড ব্যাংক আইলান্ডে যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু আমি দেখলাম সময় আরও বেশি লেগেছে।

ড্রিম অ্যাভাঞ্জার্সে কর্মরত বাঙালি যুবক বাবু মিয়া সময়ের বিষয়টা পরিষ্কার করে বললেন, স্পিড বোটের হিসেবে সময় গণনা করা।

মালদ্বীপ প্রবাসী বাবু মিয়া, পিছনের তিনজনের মাঝে মাহাদী

প্রবাসে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাবু বেশ হাসি-খুশি ছেলে! পুরো পথ জুড়ে তার প্রাণবন্ত চেহারার দিয়ে পর্যটকদের খুশি করার চেষ্টা করেছেন। পাঁচ -ক্লাস পর্যন্ত পড়া বাবু মালদ্বীপে আসা ভ্রমণ প্রেমীদের ভালো হ্যান্ডেল করা শিখেছেন। প্রয়োজনীয় ইংরেজিও বলতে পারেন। তাকে দেখে মনে পড়ে পাশের বাড়ির সহযোগিতা পরায়ণ ছেলেগুলোর কথা।

নৌকা ছুটছে- আর গাঢ় নীল সমুদ্র তার মুগ্ধতা দিয়ে গ্রাস করছে। জল ডুবুডুবু নীল দেশ মালদ্বীপ মায়ার চাদরে জড়িয়ে নিচ্ছে। কোথাও গাঢ় নীল, কোথাও আবার আকাশের নীল রঙের মতো পানি দূর থেকে আহ্বান জানায়। একটু পর পর আকাশে সি প্লেনের গর্জন, পর্যটকদের নিয়ে সাগর ছুঁই ছুঁই করছে প্লেনগুলো।

নয়নাভিরাম রিসোর্ট, এখানে বিলাসবহুল জীবন যাপন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ

আবার টইটুম্বুর সাগরে চলার পথে কখনও হাতছানি দেয় বিলাসবহুল জাহাজ বা নয়নাভিরাম সারি সারি রিসোর্ট। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাজারো পর্যটক আসেন একান্ত সময় কাটাতে। সেই সঙ্গে গুণতে হয় কাড়ি কাড়ি ডলারও। শুনেছি, মালদ্বীপের আসল সৌন্দর্য এই দ্বীপগুলোই। যদিও এবার সেই ভাগ্য হল না- তবে অপেক্ষা থাকবে সুপ্রসন্ন ভাগ্যের উপর।

১২’শর বেশি দ্বীপ নিয়ে ভারত মহাসাগরের বুকে ভেসে উঠেছে মালদ্বীপ। এই দ্বীপপুঞ্জের মোট জিডিপির ৭০ শতাংশ আসে পর্যটন শিল্প থেকে। মালদ্বীপকে ধরা হয় বিশ্বের আদর্শ ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে। ঘন নীল আর শ্যাওলা সবুজ ঢেউ খেলানো ভারত মহাসাগরের বুকে দোল খাওয়া এই অনিন্দ্য সুন্দর ভূখণ্ডের কোন তুলনা নেই। এখানে রয়েছে লোকাল আইল্যান্ড; যেগুলোতে স্থানীয়রা বসবাস করেন। আর প্রাইভেট আইল্যান্ড যা পর্যটকদের জন্য।

পানির রঙ এত গাঢ় নীল যে- মনে হবে কেউ কাপড়ে দেওয়ার নীল রঙ ঢেলে দিয়েছে

মালদ্বীপ এসে যাদের ব্যয় নিয়ে চিন্তা তাদের জন্য বেস্ট অপশন হবে হুলু মালে। মালে এয়ারপোর্ট থেকে চায়না-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ পার হলেই হুলুমালে দ্বীপ। এখানে অপেক্ষাকৃত কম দামে বিচের অদূরেই হোটেল পাওয়া যায়। যারা বিলাসবহুল রিসোর্টে রাত কাটাতে চান না; তারা এখানে রাতে থেকে স্পিড বোট ও ফেরিতে করে রিসোর্ট ডে ওয়াইজ ঘুরে আসতে পারেন। এতে খরচটা কম হয়- অর্থাৎ ‘রথ দেখাও হল কলাও বেচা হল’।

আরও পড়ুন: নীলাকাশ থেকে নেমেই নীল জলের অভ্যর্থনা!

নৌকার ইঞ্জিন যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন তার নাম মাহাদী! শ্রীলঙ্কান, গাল ভাঙা খটখটে চেহারা, লম্বা বাবরি চুল, গায়ের রঙ তামাটে। তার চোখে পড়লেই ঈষৎ হাসি দেন- কোন প্রয়োজন কিনা ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চান। চটপটে মাহাদীকে বেশ ভালো লাগল। যাত্রা পথে তিনি থেকে থেকে সিংহালি গানের সঙ্গে নাচার চেষ্টা করে পর্যটকদের মাতিয়ে রাখছেন।

স্যান্ড ব্যাংক আইল্যান্ড

ঠিক ভরদুপুরে ভারত মহাসাগরের শান্ত নীল ঢেউ পেরিয়ে স্যান্ড ব্যাংক আইল্যান্ডে পৌঁছাই। স্যান্ড স্নানগ্লাস ছাড়া চোখ মেলা দায়! স্যান্ড ব্যাংক মানে বালির তট। চারপাশের নীল জল- মাঝখানে ধপধপে সাদা বালি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এক খণ্ড গোলাকার সাদা মেঘ! বালিতে পড়ে আছে নানা রঙের কোরাল।

বেশি দেরী না করে বোট থেকে দ্রুত নেমে শুরু হল জলের খেলা। কেউ মেতে উঠেছে স্নোরকেলিং। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানির গভীরে সামুদ্রিক প্রাণীকূলের জীবন, কোরাল, মাছেদের চলাফেরা ও সৌন্দর্য দেখার জন্য স্নোরকেলিং বেস্ট। অন্যদিকে অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সার্ফিং, বোটিং-এ। আমি ছবি তোলা ও ভিডিওর কাজটিই করে গেলাম।

যে যার মতো ব্যস্ত সবাই, স্যান্ড ব্যাংক আইল্যান্ডে

এমন প্রকৃতির মাঝে আসলে মনটা কেমন জানি পালাই পালাই করে। অস্থির হয়ে ওঠে নানা অনুভূতি! ভালোলাগার মোড়কে আটকা পড়ে- নানা শূন্য ও অমূল্য স্মৃতি। তাই কোলাহলে গা না ভাসিয়ে বালুকাবেলায় মাথা ও নীল জলে পা রেখে গুণগুনিয়ে গেয়ি উঠি- ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ, একি বেদনার মত বেজেছে আবার হারানো দিন।’

প্রায় তিন ঘণ্টার মতো পানি, বালু ও মাছের সঙ্গে খেলা শেষে লাঞ্চ! বোটেই লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। টুনা ফিশ দিয়ে ফ্রাইড রাইস, নুডুলস, সালাদ এবং জুস দিয়ে সারতে হল মধ্যাহ্নভোজন। লাঞ্চ পর্ব খুব বেশি সুখকর হলো না।

পিছনে তাকালে ভেসে উঠল আকাশি রঙের জলে ঘেরা স্যান্ডব্যাংক আইল্যান্ড

মধ্যাহ্নভোজনের পরেই ফেরার পালা। আবার ঢেউয়ে ভাসলো বোট। এবার যেন আরও গাঢ় নীল সাগরের জল। পিছনে তাকালে ভেসে উঠল আকাশি রঙের জলে ঘেরা স্যান্ডব্যাংক আইল্যান্ড। কিছুক্ষণের জন্য কোলাহলে ভরে ওঠা আইল্যান্ডটি আবারও পড়ে রইলো পর্যটকের অপেক্ষায় নিঃসঙ্গ হয়ে।

স্নোরকেলিং-এ যেতে প্রস্তুত এক পর্যটক

ফেরার পথে– প্রস্তাব আসল সাগরে ডলফিন শো দেখার! ভ্রমণ অভিজ্ঞ বিটিভির সাংবাদিক সাইফুল্লাহ সুমন ভাই জানালেন, ডলফিন দেখতে হলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকতে হবে। অনেক সময় ডলফিনের দেখা যায় না। যাই হোক- ভাগ্য দেবীর উপর ভরসা রেখে ডলফিনের দেখার প্রস্তাবে সবাই রাজি হলাম। বোট এসে থামল সাগরের ডলফিনের কর্নারে। একটু পরেই শুরু হলো হুল্লোড়! একটা পর একটা সাগরের স্তন্যপায়ী জলজন্তুটি লাফ দিচ্ছি। কেউ কেউ মাথা উঁচু করে আবারও ডুবে যাচ্ছে। খুব কাছ থেকে না হলেও দেখা তো পেলাম।  

ফেরার পথে – প্রস্তাব আসল সাগরে ডলফিন শো দেখার

সমুদ্রে যাত্রার এই অভিযান শেষে সন্ধ্যার আগেই ফিরলাম জেটিতে। হোটেলে ফেরার আগে হুলুমালের সেন্ট্রাল পার্কে সন্ধ্যাটা হাঁটলাম। এখানে রাতে নানা রঙের জলের নৃত্য দেখা যায়। যেখানে শিশুরা খেলা মেতে উঠে। দিনভর চোখ ‍জুড়ানো মায়াময় প্রকৃতি দেখে ক্লান্তি টের না পেলেও বিছানায় শুইতে গিয়ে টের পেলাম। এরপর এক ঘুমে ক্লান্তি দূর হয়ে সকাল হল।

সমুদ্রে যাত্রার এই অভিযান শেষে সন্ধ্যার আগেই ফিরলাম জেটিতে

মালদ্বীপ আসলে যা জানা জরুরি

মালদ্বীপ এ on arrival visa, সুতরাং ভিসা নিয়ে টেনশন করার কোন দরকার নাই। নিজের কোন কাগজপত্র লাগবে না। ডলার এন্ডোর্সমেন্টসহ পাসপোর্ট; অবশ্যই মিনিমাম ৬ মাসের ভ্যালিডিটি থাকতে হবে। হোটেল বুকিং এর কাগজপত্র, রিটার্ন টিকেট। করোনাভাইরাসের কারণে এখন যোগ হয়েছে- করোনা নেগেটিভ সনদ, টিকা সনদ এবং ইমিগ্রেশন হেলথ ফরম পূরণের কোড।  

মালদ্বীপের অধিবাসীদের প্রায় সবারই স্কুটি বা বাইক রয়েছে। পর্যটকরা মালে শহরে যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করেন ট্যাক্সি। মালে শহরের যেই জায়গায় নামেন ৩০ রুপি ভাড়া দিতে হবে। রাজধানী মালেকে ব্রিজ দিয়ে হনুমালের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। ব্রিজ দিয়ে গেলে ট্যাক্সিতে পড়বে ৭৫ রুপি আর বোটে গেলে দশ রুপি।

মালদ্বীপের নীল জলে এক ঘণ্টা সার্ফিংয়ের জন্য ৩০-৪০ রুপি খরচ হবে। সার্ফিং, বোটিংয়ের সঙ্গে কয়েকটি রাইড নিলে প্যাকেজে ২০০-৩০০ রুপির মধ্যেও সম্ভব। মালদ্বীপের আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় প্যারাগ্লেডিং এবং সাবমেরিন। বিলাশ বহুল রিসোর্টের বিচ ভিলা ও ওয়াটার ভিলায় থাকতে হলে সর্বনিম্ন ১২০ ডলার থেকে এমন ভাড়া গুণতে হবে।

মালদ্বীপে মাছ ছাড়া নিজস্ব কোন প্রোডাক্ট নেই কাজেই কেনাকাটা আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। চকলেটের দোকান আছে, তবে সেখানে সবই বাইরের চকলেট। এছাড়া ভারতেরও কিছু চকলেট ওখানে পাওয়া যায়। সবশেষে একটা কথা বলি, পর্যাপ্ত টাকা ও সময় না নিয়ে গেলে মালদ্বীপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ও আফসোস নিয়ে ফিরতে হবে। তাই ভেবে চিন্তে ট্যুর প্লান করুন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর