প্রিয় মতি ভাই, জন্মদিনের শুভেচ্ছা

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 09:21:32

অদ্ভুত ভাবে বছরের শেষ দিনটি বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও বরেণ্য সম্পাদক, প্রিয় মতি ভাইয়ের জন্মদিন। স্কুলের শিক্ষকরা সাধারণত ১ জানুয়ারি অনেক ছাত্রের জন্মদিন লিপিবদ্ধ করেন। ফলে ১ জানুয়ারি শত শত মানুষের জন্মদিন। এবং এগুলো যত না ‘প্রকৃত’, তারচেয়ে বেশি ‘অফিসিয়াল’।

৩১ ডিসেম্বর জন্মদিন হওয়ায় প্রতিবছরই বর্ষবিদায় ও বরণে আবহের সঙ্গে তা মিশে যায়। তদুপরি, পারিবারিকভাবে ও একান্ত পরিবেশের বাইরে জন্মদিন পালনে অনেকেরই অনীহা ও অনাগ্রহ থাকে। মতি ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে কাছের লোকজন ছাড়া বিশেষ কেউ জন্মদিনের বিষয়টি জানেন না।

মতি ভাই সম্বোধনেও খানিক অসুবিধা আছে। কারণ বাংলাদেশের মিডিয়ায় মতি ভাই দুইজন। একজন প্রথম আলোর আর অন্যজন মানবজমিনের। প্রথম আলোর জনের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। চাক্ষুষ দেখা-সাক্ষাতও হয়নি। মধ্য আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাকালে সাংবাদিকতার সময় তার নাম শুনিনি। ভোরের কাগজের মাধ্যমে নব্বুই দশকে মূলস্রোতের সাংবাদিকতায় তার অভ্যুদয়।

তারুণ্যে-যৌবনে আমরা জেনেছি সংবাদ, ইত্তেফাকের মতি ভাই তথা মতিউর রহমান চৌধুরীকে, পরে যিনি বাংলাবাজার পত্রিকা ও মানবজমিনের প্রতিষ্ঠাতা হন এবং ভয়েস অব অ্যামেরিকা’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি রূপে কর্মরত রয়েছেন।

আশির দশকে বাংলাদেশে তখন কয়েকটি মাত্র দৈনিক। প্রচার ও গুরুত্বে একা ইত্তেফাক একদিকে আর অন্যদিকে মিলিতভাবে দৈনিক বাংলা, সংবাদ, বাংলার বাণী। ইনকিলাব, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, প্রথম আলো তখনো ভূমিষ্ঠ হয় নি।

আজকের মতো তখন প্রতিদিন বা প্রতিটি আইটেমের সঙ্গে প্রতিবেদকের নাম যুক্ত হওয়ার রেওয়াজ ছিল না। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যময় লেখার সঙ্গে সাংবাদিকের নাম যেতো। সেসব নাম এখনও পাঠকের মনে জীবন্ত। ইত্তেফাকের হাসান শাহরিয়ার, নাজিমুদ্দিন মোস্তান, আলমগীর হোসেন, মতিউর রহমান চৌধুরী, দৈনিক বাংলার হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ, জহিরুল হক প্রমুখের নাম ছিল পাঠকের পরিচিত।

এরা কেবল সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন ব্যক্তিত্বের আলোয় দীপ্তিমান। কয়েকজন তখনই পত্রিকা করার স্বপ্ন দেখতেন ও সেগুলো বাস্তবায়নও করেছেন। নাজিমুদ্দিন মোস্তান ‘রাষ্ট্র’ নামে কাগজ করেন। আলমগীর হোসেন ‘একাত্তর’ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার জনক রূপে আবির্ভূত এবং বিডিনিউজ২৪, বাংলালানিউজ২৪ ও বার্তা২৪-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধিও।

নব্বুই দশকের শুরুতে মতি ভাই প্রতিষ্ঠা করেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’। ঢাকার গ্রীন রোডের রাজাবাজারে প্রবেশের গলির মুখে হলুদ দোতলায় অবস্থিত অফিসে সে কালের উল্লেখযোগ্য তরুণরা যুক্ত হয়েছিলাম। মতি ভাই পরে বাংলা ভাষার প্রথম ও প্রধান ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন প্রতিষ্ঠা করেন। আর সেখানে তার বিদুষী স্ত্রী, বিশিষ্ট সংবাদ পাঠিকা, ছড়াকার মাহবুবা চৌধুরী বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকায় প্রথম নারী সম্পাদক এবং একই সঙ্গে প্রকাশক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

মতি ভাই আপাদমস্তক সাংবাদিক হিসেবে নিজের কাগজে ও অন্যত্র নামে বেনামে প্রচুর লিখেছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে বেশ কিছু সাড়া জাগানো ও মাইলস্টোন রিপোর্টের জনক তিনি। সাংবাদিকতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় রচিত একাধিক গ্রন্থে তিনি সৃজনশীলতার যে স্বাক্ষর রেখেছেন, তা মূল্যবান সম্পদ। দুনীর্তির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে তার অবস্থান প্রশ্নাতীত। এজন্য তাকে নির্যাতিত ও কারাভোগ করতে হয়েছে। তবু তিনি পিছিয়ে যান নি।

মতি ভাইয়ের সঙ্গে কাজের সূত্রে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তা অমূল্য স্মৃতি স্বরূপ। মতপার্থক্য ও মতভেদ হলে বা রাগে-অভিমানে কখনো দূরত্ব তৈরি হলেও ব্যক্তিগত সৌজন্য ও অমায়িক ব্যবহারে তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন বরাবরই। ফলে পেশা থেকে পারিবারিক বলয়ে মেলামেশায় বিন্দুমাত্র ছেদ হয় নি।

আরও ব্যাপকভাবে বললে, আশি দশকে সাংবাদিকতার যে মাধুর্য ও উষ্ণতা বিরাজমান ছিল, তা অতুলনীয় ও আন্তরিকতায় ভরপুর। অফিসের বাইরে অনেকের বাসায় নিয়মিত যাতায়াতের ঘটনা ছিল স্বাভাবিক। বিশ্বস্ততা ও আস্থার বিষয়টি ছিল সুদৃঢ়। পেশাগত প্রতিযোগিতা থাকলেও সৌজন্যে, পারস্পরিক সম্মানবোধ ও মর্যাদার দিক থেকে সবাই ছিলেন অনুকরণীয়।

মতি ভাইয়ের মধ্যে সেসব গুণ যেমন আছে, তেমনি আছে তার সমকালীনদের মধ্যেও। যাদের একজন আলমগীর হোসেন, যার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজের ফলে সেসব দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। রিপোর্টার্স ইউনিটি, কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সমিতিসহ বিভিন্ন পেশাগত সংস্থার অন্যতম নেতা হিসেবে সাংবাদিকতার পেশা ও সহকর্মীদের স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষায় তার অবদান দৃষ্টান্তমূলক। এরা আপাদমস্তক ও সার্বক্ষণিক সাংবাদিক। স্বপ্নে ও জাগরণে সাংবাদিক। নেতা বা সম্পাদকের তকমা লাগানো অন্তঃসার শূন্যদের সামনে তারা শুধু ব্যতিক্রমই নন, সমীহ আদায়কারীও।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মতি ভাইয়ের মতো আলমগীর ভাইও কাজের বাইরে জন্মদিন পালনের আনুষ্ঠানিকতার নামে সস্তা প্রচারকে মোটেও বরদাস্ত করেন না। বাংলাদেশের বর্তমানকালের সিনিয়র-মোস্ট, অ্যাক্টিভ ও ক্রিয়েটিভ সাংবাদিক-সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও এবং ইচ্ছা করলেই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন করতে পারলেও তাতে তারা আগ্রহী হন নি। নিজের আত্মমর্যাদা, পেশাগত আভিজাত্য, সৃষ্টিশীলতার তৃপ্তির মাধ্যমেই তারা তাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপন করেন। তাদের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানসমূহ আর হাতে ধরে তৈরি করা শত শত সংবাদকর্মী এবং লক্ষ-কোটি পাঠকের হৃদয়ে নিত্য উচ্চারিত হন তারা। এরচেয়ে বড় আয়োজন ও উদযাপন আর কিছুই হতে পারে না।

তথাপি মতি ভাইয়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাতে হলো কয়েকটি কারণে। কিছুদিন আগেই চলে গেছেন শুদ্ধ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মডেল, সাংবাদিক রিয়াজউদ্দীন আহমেদ। মতি ভাই হার্টের জটিল অপারেশনের পরেও কর্মময়। আলমগীর ভাই রোগকে পরোয়া না করে মেতে আছেন কর্মের আলোকিত আনন্দযজ্ঞে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সাংবাদিকতার মেধাবী, দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী জেনারশনের শেষ প্রতিনিধি তারা। লাস্ট মুঘলের মতো তারাই শিবরাত্রির সলতে হয়ে আলোকিত করছেন অবক্ষয় আর স্খলন-পতনে আকীর্ণ সাংবাদিকতার সাংবাদিকতার বিদ্যমান অন্ধকারকে। তাদের প্রতি শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। ঐতিহাসিক সামাজিক কর্তব্যের অংশ মাত্র।

এ সম্পর্কিত আরও খবর