আলিকদমের দামতুয়া জলপ্রপাত

, ফিচার

তৌফিক হাসান | 2023-08-31 21:54:43

ঝর্ণা বা জলপ্রপাত প্রেমীরা বর্ষার শেষদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। যেন ডাক আসলেই দে ছুট! আমি ও আমার তিন ভ্রমণবন্ধুরও একই অবস্থা। এক শনিবারের সন্ধ্যায় ডিজিটাল আড্ডায় হঠাৎ সিদ্ধান্ত হল বান্দরবানের আলীকদমে অবস্থিত দামতুয়া জলপ্রপাত দেখতে যাবো। সাথে সাথে সবাই রেডি, পারলে তো সেই রাতেই বেড়িয়ে পরে। অতঃপর পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হলো ভিড় এড়াতে বুধবার রাতে রওনা হবো। আজকাল ছুটির দিনে শান্তি করে সৌন্দর্য উপভোগ করবার উপায় নেই তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বুধবার রাতে গিয়ে ঝর্ণা দেখে বৃহস্পতিবার রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবো।

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ৮৫০ টাকায় রাত ১১টার নন-এসি শ্যামলী বাসে চড়ে সকাল ৭টা নাগাদ আলীকদম বাজারে নামলাম। নেমেই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে গেলাম বাজারের একটা হোটেলে। বাজারে ২/৩টা হোটেল আছে, খাবারদাবারও ভাল দামও সহনীয়। নাস্তা সেরে ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত গাড়িতে চড়ে পানবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, ভাড়া ৩০ টাকা আর সময় লাগলো ৭-৮ মিনিট। পানবাজারে গিয়ে দেখি চাঁদের গাড়ি বন্ধ, কারণ রাস্তার কাজ চলছে অগত্যা মোটরসাইকেল ঠিক করলাম আলীকদম-থানচি রোড ধরে ১৭ কিলোমিটার বা আদুপাড়ায় যাবো বলে।

পাহাড়ি পথ

মোটরসাইকেলে ভাড়া জনপ্রতি ৮০০ টাকা রিটার্ন। একটি মোটরসাইকেলে ওরা দুজন যাত্রী নেয়, চালক সকালে নামিয়ে দিয়ে যায় আবার বিকেলে এসে ফেরত নিয়ে যায়। আলীকদম-থানচি রাস্তাটি বাংলাদেশের উচ্চতম রাস্তা যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তৈরি করেছে এবং এখনো তারাই এই রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ৩৫ কিলোমিটারের এই উঁচুনিচু পাহাড়ি সড়কটি চলে গেছে আলীকদম থেকে থানচিতে। এই সড়কেই বহুল আলোচিত 'ডিম' পাহাড় অবস্থিত। এপথে একাধিক আর্মি চেকপোস্ট আছে এবং সেখানে এনআইডি কার্ড প্রদর্শন করে যথাযত পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হবে। আলীকদম প্রবেশ করার আগে এবং আলীকদম ছেড়ে কিছুদূর যাবার পর ১০ কিলোমিটার নামক স্থানে আর্মি চেকপোস্টে এনআইডি কপি জমা দিয়ে যথাযতভাবে পরিচয় লিপিবন্ধ করতে হবে। মোটরসাইকেলে ২৫-৩০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম ১৭ কিলোমিটারে। সেখান থেকে ১০০০ টাকার বিনিময়ে মাংরুম নামের এক কিশোর গাইড নিয়ে শুরু হলো আমাদের মূল ট্রেকিং । ১৭ কিলোমিটার স্টপেজ সংলগ্ন গ্রামটার নাম আদুপাড়া, সেই গ্রাম ছাড়িয়ে সামান্য যেতেই বেশ কয়েকটা খাঁড়া পাহাড়ের মুখোমুখি হলাম।

আলিকদমের দামতুয়া জলপ্রপাত


পাহাড়ে ট্রেকিং মানেই চড়াই-উৎরাই, তারপরও সকাল-সকাল খাড়া ট্রেক সবার হাঁপ ধরিয়ে দিলো। খাড়া পাহাড় ডিঙ্গিয়ে কিছুদূর যাবার পর হাতের বামে দিকে বেশ খানিকটা দূরে দেখা গেল একটা মায়াবী ঝর্ণা নাম “তং প্র”। দৃষ্টি সীমায় কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকায় খোলা খাদের অপর প্রান্তে পুরো ঝর্ণাটা দৃশ্যমান হলো। ট্রেক শুরু করার পর মোটামুটি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই দেখা পেলাম এই ঝর্ণার। “তং প্র” এর কাছে যাওয়া আমাদের প্লানে ছিল না, তাছাড়া অকস্মাৎ বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল তাই দেরি না করে দামতুয়ার দিকে পা বাড়ালাম। পাহাড়ের বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে হাঁটা কিন্তু খুবই রোমাঞ্চকর। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে পথ হয়ে যায় পিচ্ছিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ, তারপরও পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করায় আলাদা একটা মজা আছে। টিনের চালের বৃষ্টির যেমন একটা ছন্দ আছে, পাহাড়ি গাছের পাতায় পানি পড়ার শব্দটা কিন্তু অন্যরকম ছন্দময়। পাহাড়ে বৃষ্টি মানে উন্মত্ততা ও উচ্ছলতা। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ঝিরিগুলো উচ্ছল হয়ে উঠে, জলপ্রপাত কিংবা ঝর্ণাগুলো হয়ে উঠে উন্মত্ত।

ব্যাঙ ঝিরি

বৃষ্টির মাথায় নিয়ে খানিকটা যেতেই একটা ঝুম খেতে ঢুকে পরলাম। ক্ষেতে সুন্দর ধান ফলেছে, পাহাড়ের ঝুমক্ষেতগুলো কিন্তু খুব সুন্দর লাগে দেখতে। জুমক্ষেত পেরিয়ে সামান্য যেতেই একটা ঝিরি পড়লো নাম ওয়াং পা। আমাদের ট্রেক রুটের প্রথম ঝিরি, পাথরের বোল্ডারগুলোও বড়-বড় উপরন্তু বৃষ্টি হওয়াতে পানির স্রোত খানিকটা বেশি। ঝিরি থেকে উঠে কিছুদূর যেতেই একটা গ্রাম পড়লো নাম পামিয়া পাড়া। এই পথের সবগুলো গ্রামই মুরং গ্রাম, লোক সংখ্যাও বেশ কম। ঘরগুলো মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে বানানো, বাঁশ দিয়ে তৈরি উপরে খড়ের ছাউনি। পাহাড়ে সব বাড়িগুলোই মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে বানানো হয়। এরকম আরও দুটি গ্রাম পেরিয়ে, ঝিরির জলে পা ডুবিয়ে, গা ছমছমে জঙ্গলের মধ্যদিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম দামতুয়ার দিকে। গাইড আমাদের বেশ তাড়া দিচ্ছিলো কারণ ছবি তোলা এবং ভিডিও করার জন্য আমরা বেশ সময় নষ্ট করছিলাম। আমাদের আজই ফিরতে হবে এবং নিয়মানুযায়ী ফেরার পথে ১০ কিলোমিটারের আর্মি ক্যাম্পটা বিকেল ৫টার মধ্যেই পার হতে হবে। কেউ যদি থাকে রাতে পাহাড়ে থাকতে চায় তাহলে যাবার সময় আর্মি ক্যাম্পে ইনফর্ম করে যেতে হবে। থাকার ব্যাপারে গাইডকে আগেভাগে জানালে পাহাড়ি কোনো বাড়িতে সে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।

নৈসর্গিক পাহাড়

যাইহোক রোদ বৃষ্টি মাথায় করে চলতে চলতে একসময় দামতুয়া ঝিরিতে পৌঁছে বড় একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলাম আমরা। মোটামুটি ৩ ঘণ্টার মতো আমরা হাটছি, গাইড জানলো এখান থেকে দামতুয়া জলপ্রপাত আর বেশি দূরে নয়। আরও ২৫-৩০ মিনিট লাগবে দামতুয়াতে পৌঁছতে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খুব সাবধানে চলতে শুরু করলাম কারণ দামতুয়া ঝিরিতে পানির পরিমাণ বেশি, পাথরগুলোও বড় এবং পিচ্ছিল। চঞ্চলা কিশোরীর মতো বয়ে চলা দামতুয়া ঝিরিকে কয়েকবার ক্রস করে একসময় পৌঁছে গেলাম ব্যাঙঝিরিতে, ব্যাঙঝিরি থেকে সামান্য গিয়ে খাঁড়া নিচের দিকে নামতে হলো। জায়গাটা বেশ খাঁড়া এবং বৃষ্টির কারণে বেশ পিচ্ছিল হয়েছে। খুব সাবধানে বেশ খানিকটা নেমেই পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত দামতুয়া জলপ্রপাত বা ঝর্ণা। মুহূর্তেই সকল ক্লান্তি চলে গেল এমন বিশাল জলপ্রপাত দেখে।

দামতুয়া জলপ্রপাত বা ঝর্ণাকে নানাজনে নানা নামে ডাকে। দামতুয়া, তুক-অ বা লামোনাই নামেও ডাকা হয়ে থাকে এই জলপ্রপাতকে । তুক-অ বা ব্যাঙঝিরির পানি খানিকটা নিচের দিকে গিয়ে দুই-তিন ধারায় পতিত হয়ে দামতুয়া প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। এলাকাটি মুরং অধ্যুষিত এবং মুরং ভাষায় ব্যাঙ হলো “তুক” আর ঝিরি হলো “ অ”। এই জলপ্রপাতের বিশেষত্ত হলো এর একাধিক পানির ধারা, দুই-তিন ধারায় পানি পরলেও মূলত দুটা ধারাই বড়। এই দুই ধারা মাঝে বেশখানিকটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। দামতুয়াতে ধারায় অবগাহন করে, সাঁতার কেটে, খোলা চোখে এর সৌন্দর্য উপভোগ করে এবং ফ্রেমবন্দি করতে করতে অনেকটা সময় পার হলো। গাইড তাড়া দিল ফিরতে হবে বলে। গাইডের তাড়া দেওয়া সত্ত্বেও আরও কিছুটা সময় থাকলাম বিশালতা ও শুভ্রতার কাছে। একবারে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরতি পথ ধরলাম কারণ সবাইকে একসময় ফিরতে হয় বলে…

এ সম্পর্কিত আরও খবর