আমাদের সেন্ট মার্টিন আর হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ

, ফিচার

ডা. দলিলুর রহমান | 2023-09-01 14:01:29

  • প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে জাহাজে, স্পিড বোটে, ট্রলারে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন পর্যটক পদচিহ্ন আঁকেন স্বপ্নের এই দ্বীপে।
  • চতুর্পাশে সাগরের স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর আকাশের নীল মিলেমিশে একাকার। সারি সারি নারিকেল গাছ, কেয়া বন আর সাগরতলের মায়াময় স্নিগ্ধতা । ভাটায় জেগে উঠে নান্দনিক প্রবাল প্রাচীর, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলে গাঙচিল, পশ্চিম বিচ থেকে দেখা সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য, সৈকতে নরম কোমল স্নিগ্ধ বাতাস । সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের সেন্ট মার্টিন ।

অবস্থান:

দ্বীপটির প্রধান গঠন উপাদান হলো চুনাপাথর। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত টেকনাফ উপজেলার সর্ব-দক্ষিণের একটি ইউনিয়ন।  এটি টেকনাফ থানা সদর থেকে প্রায় ৩৫  কিলোমিটার দক্ষিণে ও মায়ানমার-এর উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে  নাফ নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। এ ইউনিয়নের গ্রামগুলো হল:পশ্চিমপাড়া, পূর্বপাড়া, দক্ষিণপাড়া, উত্তরপাড়া, নজরুলপাড়া, মাঝেরপাড়া, ডেইলপাড়া, কোনারপাড়া,  গলাচিপাপাড়া । প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্ট মার্টিন্সের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।

ইতিহাস ও নামকরণ:  

  • প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এখানে লোক বসতি শুরু হয়।
  • প্রায় ৫০০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে উঠে। এর ১০০ বছর উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে উঠে। ১৯০০ সালে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। ( অধ্যাপক বখতিয়ার উদ্দিন, চ বি ) 
  • ২৫০ বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে এ দ্বীপটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা এ দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিতো। তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেছিল 'জাজিরা'। পরবর্তীতে যেটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়। (অধ্যাপক মোস্তফা কামাল পাশা, চ বি)
  • বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, ১৮৯০ সালে কিছু মৎস্যজীবী এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে কিছু বাঙালি এবং কিছু রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক ছিল। ধীরে-ধীরে এটি বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা হয়ে উঠে।

দ্বীপের মানুষ:

দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা মৎস আহরণ, শুটকি প্রকৃয়াকরণ, সামান্য চাষাবাদ ও পর্যটন সেবার উপর নির্ভরশীল। দ্বীপটির উত্তর পাড়া এবং দক্ষিণ পাড়া দু’জায়গারই প্রায় মাঝখানে জলাভূমি আছে। এগুলো মিঠা পানি সমৃদ্ধ এবং ফসল উৎপাদনে সহায়ক। দ্বীপটিতে কিছু কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাক্ষরতার হার ১৫.১৩% এ ইউনিয়নে ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। দ্বীপের সর্ব দক্ষিণে প্রায় ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের পৃথক আরেকটি দ্বীপ আছে যা ছেঁড়া দ্বীপ নামে পরিচিত। ছেঁড়া দ্বীপে কোনো লোক বসতি নেই কিন্তু বড় বড় ঢেউ আর অনেক  জীবন্ত প্রবাল আছে  ।

উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর এই দ্বীপে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক - ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তবীজী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও ১২০ প্রজাতির পাখি ও ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া নারিকেল গাছ ও কেয়া বন ছাড়াও সেখানে বাইন, শেওড়া, কেওড়া ও কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ দেখা যায়।

দ্বীপের হুমকি:

  • পুরো দ্বীপজুড়ে প্লাস্টিক-ময়লা-আবর্জনার কোন ব্যবস্থা না থাকায় লক্ষ লক্ষ পর্যটকের   যত্রতত্র ফেলে আসা লক্ষ লক্ষ পরিত্যাক্ত প্ল্যাস্টিক বোতল, ছোট বড় বিভিন্ন প্ল্যাস্টিক প্যাকেট, প্লাস্টিকের বর্জ্য এর কারনে সুন্দর নয়নাভিরাম দ্বীপটি অপরিচ্ছন্ন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। 
  • পর্যটকদের চাহিদা পূরণে দ্বীপের ভূগর্ভস্থ সুপেয় মিঠা পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে। এ কারণে নলকূপ থেকে লবণাক্ত পানি আসছে।
  • পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরণের কাজই হচ্ছে দ্বীপটিতে যেমন যত্র তত্র অনুমোদনহীন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, বাসা বাড়ি গড়ে উঠা, পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা, ভারী জেনারেটর, পাম্প পরিচালনা, পাথর তোলা, সৈকতের বালি অপসারণ এর কারণে দ্বীপটি হুমকির মুখে আছে।

দ্বীপ রক্ষা ও পর্যটক বান্ধব সেন্ট মার্টিন এর জন্য করণীয়:

  • পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনসহ স্থানীয় সবাইকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
  • যত্র তত্র প্ল্যাস্টিক বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে।
  • এক্স নটরডেমিয়ান্স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও ব্লু মেরিন রিসোর্ট এর ক্লিন সেন্ট মার্টিন প্রকপ্লের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাহিনী দ্বারা ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সকলের সহযোগিতায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। 
  • আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ও রিসাইক্লিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
  • দ্বীপে মিঠা পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • নিয়মতান্ত্রিকভাবে পর্যটকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
  • দ্বীপের ভিতরের রাস্তা, কালবার্টগুলো মেরামত করতে হবে।
  • পর্যটকদের সেবা প্রদানকারী স্থানীয় রিকশা/ভ্যান চালক, হোটেল মালিক ও দোকানদার দেরকে পর্যটক বান্ধব হতে হবে।
  • জেটি ঘাট ভালোভাবে মেরামত করতে হবে এবং জাহাজে উঠানামা সহজতর করতে হবে।

ডা. দলিলুর রহমান, চেয়ারম্যান, ক্লিন সেন্ট মার্টিন প্রকল্প, বাস্তবায়নে নটরডেমিয়ান্স ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন এন্ড ব্লু মেরিন রিসোট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর