সমুদ্রকন্যা সেন্টমার্টিন ভ্রমণে স্বপ্নভঙ্গের অ্যাখ্যান!

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 11:19:22

ডানার উড়ালে গাঙচিলের দল দেখায় ‘সমুদ্র পথ’। আদিঅন্তহীন সুনীল আকাশ আর নীল জলের মিতালি পেরিয়ে সারি সারি নারিকেল গাছ, কেয়াবিথী।  ঢেউয়ের সাথে প্রাণের উচ্ছ্বাসে উন্মুক্ত বালুকাময় সৈকতের আবাহন। প্রবালের গা ঘেঁষে স্বচ্ছ নীল জলের প্রবাহে এসে টের পাওয়া যায় নিশীথ রাতে সমুদ্রের মৃদু সুরের নিঃসঙ্গ গান। এমন নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সমুদ্রকন্যা সেন্ট মার্টিন পর্যটকদের এভাবেই জানালো স্বাগতম।

গাঙচিলের উড়াউড়ি

সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের পর্যটনের প্রাণ। কেউ বলে দারুচিনি দ্বীপ। আবার তাকে বলা হয় নারিকেল জিঞ্জিরা। অনেকের স্বপ্নের ভ্রমণ গন্তব্য। তবে আমার সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ ঘুমের মধ্যে অনিন্দিত সুন্দর স্বপ্ন দেখার শিহরিত ধাক্কার মতো। বর্তমানে পর্যটকদের বাড়তি চাপ, পরিকল্পনার অভাব ও অনিয়মে সেন্ট মার্টিনের এমনই দশা যেন টুটি চেপে ধরেছে পর্যটনের প্রাণকে।

 সারি সারি নারিকেল গাছ

প্রথমবার সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ। জাহাজ থেকে নেমেই জেটিতে দাঁড়িয়ে ‘ভ্যাবাচ্যাকা’ খাওয়ার অবস্থা! সামনে এক দঙ্গল মানুষের মিছিল, অটোরিকশার জ্যাম! গুগলে চকচকে ছবিতে দেখা সেন্ট মার্টিন প্রথমেই বুকে খামচি দিল বিশৃঙ্খল আবহে।

হোয়াটসঅ্যাপে বুকিং করা রিসোর্টের ঠিকানাটা চেক করে নিলাম! ‘যাই-আসি’ করা নেটের সাহায্য নিয়ে গুগলে সার্চ দিতেই জানান দিল- আশেপাশে না।

আদিঅন্তহীন সুনীল আকাশ আর নীল জলের মিতালি

অটোরিকশা চালকের কাছে যেতেই-যাবেন কই? প্রশ্ন ছুঁড়ে দলবেঁধে দাঁড়ালেন চালকরা। কড়া রোদে দাঁড়িয়ে তাদের অটোরিকশার বয়ান শুনতে হলো। সেই সঙ্গে তাদের কাছে জানলাম ‘গন্তব্য বহুদূর।’ অটো চালকের ভাষায়- ‘১ ঘণ্টার মতো লাগবে; ভাড়া ১২০০ টাকা।’ অথচ বাস্তবে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগল ২০ মিনিটের মতো। দেখলেন তো- গলাটা কেটে দিলো। শুরুর দিকের এমন অভিজ্ঞতা সেন্ট মার্টিনে ঘোরার পদে পদে!

ডানার উড়ালে গাঙচিলের দল দেখায় ‘সমুদ্র পথ’

যাইহোক এক অটোচালকের কথায় পটে গিয়ে তলপি-তল্পাসহ গাদাগাদি করে বসলাম। যদিও অটোচালক আশ্বাস দিয়েছিলেন তার অটো বড়, আট জন বসা যাবে। বাস্তবে ঠেলেঠুলে ৬জনই ধরেছে!

রিসোর্টের পথে বেহাল রাস্তা!

অটোচালকের সাবধানী বক্তব্য- ‘শক্ত করে ধরেন, রাস্তা কিন্তু খারাপ’! খারাপ- এতটা খারাপ যে একবার গেলে ওপথে পা বাড়ানোর জন্য বহুবার ভাববেন। সেন্ট মার্টিনে জলপথে ট্রলার, জাহাজ, নৌকা। আর স্থল পথে একমাত্র ভরসা সাইকেল ও অটোরিকশা। তারপরও বিচের ধারে সাইকেল চালালে অসম্ভব ভালো লাগা আপনাকে ঘিরে ধরবে।

ছেঁড়াদ্বীপ

ইট বিছানো, কোথাও নারিকেলের বাকল বিছিয়ে দেওয়া, কোন কোন স্থানে এক হাত সমান গর্ত, ধুলোয় ভরা মাটির রাস্তা, জায়গায় জায়গায় অসমান পিচ বিছানো, অটোচালক পারদর্শী না হলে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা-রিসোর্ট যাওয়ার ২০ মিনিটের পথের এই ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতা। পর্যটন দ্বীপের সড়কের এমন করুণ রূপ দেখে- অনেকের মনে ‘এখনও অনেকদূর যেতে হবে বাংলাদেশকে’- এ রকমটাই মাথায় আসবে।

পর্যটন দ্বীপের সড়কের এমন করুণ রূপ

রিসোর্টে বিড়ম্বনা!

পথের চিত্র দেখে রিসোর্ট নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করে। কারণ ফেসবুক দেখে বুকিং করা; না জানি কেমন হবে? স্যান্ড ক্যাসেল রিসোর্ট, সেন্ট মার্টিনের গলাচিপা নামক স্থানে অবস্থিত। একেবারেই সমুদ্র ঘেঁষা রিসোর্টটি, অসাধারণ বিচ ভিউ। মালদ্বীপের ছোট ছোট কোটেজের আদলে বানানোর চেষ্টা দেখা গেছে। রিসোর্টের বারান্দায় বসে সমুদ্রের গর্জন ও ঢেউ গোনা যায়। বালুচরে নানা রঙের শামুক ঝিনুক পড়ে আছে। সাগরের তীরে নারিকেল গাছের বিথী দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে।  

সাগরপাড়ে সূর্যাস্ত

তবে রিসোর্টটি এখনও নির্মাণাধীন; চারটি রুম থাকার উপযোগী হয়েছে। পরিষেবা ও মনোভাব দেখে বোঝা গেল- মালিকের ইচ্ছা পর্যটকদের গলাকেটে বাকি নির্মাণ শেষ করার।

বিদ্যুতহীন দ্বীপের রিসোর্টে জেনারেটর ব্যবস্থার ঠিক নাই। মাত্রাতিরিক্ত খাবারের দাম। এমনকি প্লেট গ্লাসেরও অভাব! সকালের নাস্তা শেষ হলেই পর্যটকদের তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগা। খাবারের বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘ সবকিছু জাহাজে করে আনতে হয়, তাই দামটা বেশি। আশেপাশে কিচ্ছু পাওয়া যায় না-এসব বলেই খালাস।’

বালুচরে নানা রঙের শামুক ঝিনুক পড়ে আছে

পুরো দ্বীপটিতে  অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে রিসোর্ট, হোটেল-মোটেল। গুণ, মান, পরিষেবা দিক আর না দিক কাড়ি কাড়ি টাকা পকেটে পুরছেন এসব হোটেল- রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। সবকিছু মিলে স্যান্ড ক্যাসেল রিসোর্টকেও ব্যাঙের ছাতাই বলা যায়।

হুমকির মুখে পরিবেশ

পর্যটকদের যাতায়াত, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেন্ট মার্টিনের জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফরের মতে, পরিবেশ দূষণের কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্য এখন বিলুপ্ত হবার পথে।

সচেতনতার জন্য প্লাস্টিকের মূর‌্যাল তৈরি করা হয়েছে

পরিবেশবিদ  ফাহমিদা খানম বলেন, এখানে আসলে সবার চেষ্টা লাগবে। একা পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষে সব করা সম্ভব না। সবকিছুর এখতিয়ারও আমাদের নেই। পর্যটকদের সচেতন হওয়াও জরুরি।

ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমণ

১০-১৫ বর্গ কিলোমিটারের সেন্টমার্টিনের কিছু দূরেই ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। চারপাশে নীল পানি, মাঝখানে ছেঁড়াদ্বীপ। বর্তমানে ছেঁড়াদ্বীপে জলযানে যাতায়াত নিষেধ। তবে অটোরিকশায় করে যাওয়া যায়। রিসোর্ট থেকে ১৫ মিনিটের পথ। এটুকু পথ রিজার্ভ ভাড়া নিলেন ১২০০ টাকা। এরপর পৌঁছানোর পর থেকেই কল তাড়াতাড়ি ফেরার। স্বচ্ছ নীলাভ জলের ছেঁড়াদ্বীপে নামলেই মোহনীয় অনুভূতি ছড়িয়ে পড়বে। তবে এত পর্যটক সুন্দর ভিউ দেখে একা দাঁড়িয়ে একটা ছবি তোলাও দায়!

স্বচ্ছ নীলাভ জলের ছেঁড়াদ্বীপে নামলেই মোহনীয় অনুভূতি ছড়িয়ে পড়বে

তার উপর ট্রলার নৌকা ভাড়া, ছোট নৌকা ভাড়া, ঘাট ভাড়া। সবকিছুতে টাকার বাড়তি খরচ মনকে বিষাক্ত করে দিতে বাধ্য।

সমুদ্রের কোলে বসে চড়া দামে সামুদ্রিক মাছ খাওয়া!

সেন্ট মার্টিনে ঘুরতে গিয়ে সমুদ্রের পানিতে দল বেঁধে সাঁতার কেটে, জলকেলি করে আনন্দময় সময় কাটান পর্যটকরা। খোলা-মেলা বালুকাময় সমুদ্র সৈকত আর সমুদ্রের বিরামহীন গর্জনে মনকে চাঙা করে তোলেন। তবে সেন্ট মার্টিন ঘুরতে আসা পর্যটকদের অভিযোগের অন্ত নেই।

সেন্ট মার্টিনে ঘুরতে গিয়ে সমুদ্রের পানিতে দল বেঁধে সাঁতার কেটে, জলকেলি করে আনন্দময় সময় কাটান পর্যটক

পানি-সাদা ভাত থেকে শুরু থেকে সবকিছুতেই বাড়তি খরচ। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের আগুন দাম। খাবারের দোকানে সাজিয়ে রাখা হয় নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ। পছন্দ করে দিলে সঙ্গে সঙ্গে ভেজে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর চলে বারবিকিউ। ১২০০-২০০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় কোরাল, টুনা ফিশসহ বিভিন্ন মাছ। এছাড়া প্রতিটা পণ্যতেই গায়ের মূল্যের তুলনায় ৫০-২০০ টাকা বেশি রাখা হয়।

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপে পর্যটকের উল্লাস

এখানকার অটোরিকশা চালক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবার মধ্যে পর্যটকের পকেট কাটার মনোভাব। যা এক অটো চালকের কথায় বোঝা গেল। অটো চালক ইউনুস বলেন, এখানে ৪-৬ মাস পর্যটকরা আসেন। এই সময়ে সবার ব্যবসা।

সাজিদা ইসলাম পারুল নামে এক পর্যটক বলেন, সেন্ট মার্টিনে ম্যানেজ করে কম টাকায় ঘোরা গেলেও খেতেই আমার সব টাকা শেষ। একটা পর্যটন কেন্দ্রে এমন হওয়াটা খুবই অনুচিত। এখনকার সবাইকে পর্যটন বান্ধব হতে হবে।

 সরকার যদি একটু হৃদয়বান আর যত্নবান হয়, তাহলে সেন্ট মার্টিন পরিণত হবে বিশ্ববাসীর স্বপ্নের গন্তব্যে

স্কুল শিক্ষিকা সোহানা শারমীন বলেন, পুরো দ্বীপ ঘুরে মনে হয়েছে সরকার যদি একটু হৃদয়বান আর যত্নবান হয়, তাহলে সেন্ট মার্টিন পরিণত হবে বিশ্ববাসীর স্বপ্নের গন্তব্যে। দেশি-বিদেশি পর্যটদের ভিড়ে নেচে উঠবে এই দ্বীপটি। সেজন্য বিশেষ পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও পদক্ষেপ লাগবে। কিন্তু সেটারই দেখা নেই। ফ্রিস্টাইলে চলছে নান্দনিক পর্যটক কেন্দ্র সেন্ট মার্টিনের গলা-কাটা ব্যবসা আর শৃঙ্খলাহীন যাবতীয় কার্যক্রম! চলছে একবুক স্বপ্ন নিয়ে আসা পর্যটকদের স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর