তুরাগ পাড়ের কান্না: ভাগ্য নিয়ে রোহিঙ্গা তামাশা

, ফিচার

জাকারিয়া মন্ডল | 2023-09-01 22:48:10

জালপাতার জন্য নদীতে গড়া বাঁশের কাঠামো ভাঙ্গছেন এক জেলে। তুরাগে এবার মাছের মৌসুম অনেক আগেই শেষ। বাঁশগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আসছে মৌসুমে হয়তো ফের কাজে দেবে। তাই দূষিত হয়ে পড়া তুরাগের বুক থেকে বাঁশ উদ্ধারে এসেছেন। হঠাৎ অপর তীরে একজনকে জাল ফেলতে দেখে চোখ কপালে উঠলো তার।

যিনি জাল ফেললেন, তার নাম নূর ইসলাম। বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ। জামগড়ায় কুটুম বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। কোনো নদী যে কখনও মাছশূন্য হয়ে পড়তে পারে সেটা বিশ্বাস হয়নি তার। তাই জাল নিয়ে নদীতে আসা। সঙ্গে ভাইপো শাকিল।

কিন্তু প্রথম খেওয়ে যে মাছটা উঠলো তা দেখে বিস্মিত দুজনেই। কালো গায়ে হলুদ ফুটি। ধারালো পাখনা। বড় আকারের ভোঁতা মাথা। এমন মাছ আগে দেখেননি তারা। তুরাগের জেলেরা এ মাছের নাম দিয়েছে ‘রোহিঙ্গা মাছ’। তারা বলছে, আগে এই মাছ এখানে কেউই দেখেনি। যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে,  সেই সময় থেকেই তুরাগে এ মাছ দেখা যাচ্ছে। এ মাছের নাম তাই রোহিঙ্গা মাছ।

রোহিঙ্গা মাছের গায়ে কটূ গন্ধ। স্বাদও ভালো নয়

কার্তিকের পর যখন গোটা তুরাগের পানি দূষিত হয়ে পড়ে। নদীটা হয়ে যায মাছশূন্য। জেলেরা জাল গুটিয়ে জীবিকার অনিশ্চয়তায় দিন গোনেন। তখন পুরো তুরাগ সয়লাব থাকে কেবল এই মাছে। এ মাছের গায়ে কটূ গন্ধ। স্বাদও ভালো নয়। তাই খাদ্য হিসেবে এ মাছের কোনো চাহিদা তৈরি হয়নি।  কিন্তু বেড়াতে আসা নূর ইসলামদের তা জানা নেই। মনের খুশিতে ব্যাগ ভর্তি রোহিঙ্গা মাছ নিয়ে ফিরে গেলেন তারা।

এই রোহিঙ্গা মাছ এখন তুরাগ পাড়ের জেলেদের মাথায় মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মতো। বিরুলিয়া  জেলেপল্লীর গয়ানাথ রাজবংশীর আক্ষেপ, না যায় খাওয়া। না হয় বিক্রি। এই মাছ আমাদের ভাগ্যের সঙ্গে বড় একটা তামাশা। রোহিঙ্গারা দেশে আসার আগে এই মাছ আমরা কখনও দেখি নাই।

একই মত রুস্তমপুর জেলে পল্লীর রামদাস রাজবংশী, আশুলিয়া বাজার উত্তরপাড়ার হৃদয় রাজবংশী. জামগড়ার সোহেল শেখ, মজলিশপুরের রবীন্দ্র চন্দ্র দাসের।

কাশিমপুর জেলে পল্লীর দশরথ বর্মন বলেন, নদীর বাঁকে, যেখানটাতে স্রোত  ধীরে বয়, সেখানে রোহিঙ্গা উছলায়।

দেশের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে এই রোহিঙ্গা মাছের অস্তিত্ব মিলছে। এর নাম সাকার ফিশ।

ইদানিং শুধু তুরাগ নয়, দেশের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে এই রোহিঙ্গা মাছের অস্তিত্ব মিলছে। এর নাম সাকার ফিশ। কেউ কেউ অ্যাকুরিয়ামে এই মাছ পালেন মূলত ময়লা খাওয়ার জন্য। এরা রাক্ষুসে নয়। তবে ভীষণ পেটুক। অন্য মাছের খাবার খেয়ে শেষ করে। সাবাড় করে মাছের ডিম, পোনা। দ্রুত বংশ বৃদ্ধিতে সক্ষম বলে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। পানি শূন্য ডাঙ্গায় টিকে থাকতে পারে ২৪ ঘণ্টা। লাফিয়ে লাফিয়ে এক জলাশয় থেকে আর এক জলাশয়ে পার হয়।

শোনা যায়, ইউরোপের এক কূটনীতিক ২০০১ কি ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তার মেয়াদ শেষে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে নিজের অ্যাকুরিয়ামের সাকার ফিশ গুলশান লেকে ছেড়ে দিয়ে যান। সত্য বা মিথ্যা যাই হোক, এই মাছ এখন পুরো মৎস্য খাতেরই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

কিছু দিন আগে মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জেলা ও মাছ চাষিদের প্রতি এ মাছ নিধনের আহবান জানানো হয়েছে।

মৎস্য আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতিসাধন করে, এমন যে কোনো বিদেশি মাছ আমদানি ও চাষ দণ্ডনীয় অপরাধ।

কিন্তু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া সাকার ফিশের দায় যাবে কার ঘাড়ে?

জানা যাচ্ছে, এ মাছের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। বিশেষ করে, ব্রাজিলের আমাজান অববাহিকা। সেখান থেকে এই মাছ এ দেশে কে আনলো? এমনিতেই বছরের অর্ধেক সময় তুরাগে মাছ থাকে না। যে সময়টুকুতে থাকে, সে সময়টুকুতেও মাছের পরিমাণ পানির এই রোহিঙ্গারা কমিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা তুরাগ পাড়ের জেলেদের।

জাকারিয়া মন্ডল: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও ফেলো, রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)

এ সম্পর্কিত আরও খবর