পহেলা বৈশাখ: এবার বিবর্ণ নববর্ষের দুঃস্বপ্ন ভোলার দিন

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 12:31:17

বেজে উঠবে ভেপু, ঢাক-ঢোলে পড়বে বাড়ি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় লাল-সাদা পাড়ের শাড়িতে সাজা ললনার রঙিন চুড়ি বেজে উঠবে রিনিঝিনি, চলার পথে হাসির ঝঙ্কারে কেঁপে উঠবে হাজারো তরুণ-যুবকের হৃদয়, নাগরদোলার ক্যাচক্যাচ শব্দ নিয়ে যাবে হারানো শৈশবে।

গত দুই বছরে করোনাভাইরাসের কালো থাবায় সব রঙ হারিয়ে ফেলা 'পহেলা বৈশাখ', এবার আবার ফিরে পাচ্ছে তার রূপ-রঙ। বিবর্ণ নববর্ষের দুঃস্বপ্ন ভুলে পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ; ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৪২৯-কে নতুনের আবাহনে বরণ করবে বাঙালি জাতি। রমনা বটমূলে নতুন বছরের সূর্যকে ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’গানে স্বাগত জানিয়ে দিনের উৎসবের সূচনা করবে। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে দিনভর নানা আয়োজনে রুদ্র বৈশাখকে বরণ করবে বাঙালি জাতি।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। অতীতের ভুলত্রুটি ভুলে নতুন উদ্যমে জীবনের পথচলা শুরু করার বন্দনা করে এ দিনে। ইতিহাসের ভাষ্যে, বাংলা নববর্ষ পালনের শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে। তখনকার দিনে বাংলার কৃষকরা জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীর খাজনা পরিশোধ করতেন চৈত্রমাসের শেষদিন। পরের দিন, নতুন সূর্যোদয়ে তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন ভূস্বামীরা। আর এ উপলক্ষে বসত মেলা; আয়োজিত হতো নানা অনুষ্ঠান।

১৯৬০-এর দশকে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতর ভাষা হিসেবে ঢাকার রমনা বটমূলে নববর্ষ উদযাপন শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ছায়ানট'। সেই থেকে কালক্রমে এটি পরিণত হয় জাতীয় উৎসবে।

এবারও রমনার বটমূলে সকালে ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে স্বাগত জানাবেন নতুন বাংলা বছরকে। এরপর হাজারো প্রাণের কল্লোলে বেজে উঠবে ‘মেলাই যাইরে…’ জাগো নতুন প্রভাত জাগো নতুন সময় হলো..’ ‘আলোকের ঐই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও..’।

১৯৮৯ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখী সাজে নানা বাহারি মুখোশ, শোলার পাখি, টেপা পুতুল হাতে হাতে নিয়ে ঢাক-ঢোল-বাঁশি বাজিয়ে হাজরো মানুষ অংশ নেন মঙ্গল শোভাযাত্রায়।

দুই বছর পর এবার সকল দুঃখ-গ্লানি মুছে নতুনের আবাহনে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে। কয়েক মাস ধরে চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রস্তুতি নিয়েছেন। দিন-রাত খেটে বানিয়েছেন একেকটি মোটিফ।

নিরাপত্তা জনিত কারণে এবার পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নজর। দুপুরের মধ্যে নববরর্ষের আয়োজন শেষ করতে বলেছে ডিএমপি।

১৪২৯ বাংলা সনকে বরণ করে নিতে মানুষের মধ্যে এবার ব্যাপক উন্মাদনা দেখা গেছে। নতুন বছরের প্রথম দিনটাতে নিজেকে সাজাতে কেনাকাটাও সেরে নিয়েছেন মানুষ। নতুন পোশাকে সেজে রমনার বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তের বাহারি সাজে উচ্ছ্বলতায় ঘুরে বেড়াবেন তারা। এসবের মধ্যে দিয়েই দীর্ঘ দুই বছর পর আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে বৈশাখের আয়োজন।

নববর্ষ ঘিরে শহরে-গ্রামে-পথে-প্রান্তরে 'বৈশাখী মেলা'র রেওয়াজ বহুকালের। গ্রাম বাংলার মানুষ সমস্বরে ‘মেলায় যাই রে’ গাইতে গাইতে ছুটে যান এসব মেলা। মেলায় নগরদোলা, হাওয়াই মিঠাই, মৃৎ-শিল্পের জিনিসপত্রের পসরায় নিজেকে নিয়ে যায় খাঁটি বাঙালির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির শেকড়ে। বর্ষবরণে স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। সার্বজনিন এ উৎসবে উন্মাদনা –উত্তাল আনন্দে মেতে উঠে তরুণ-তরুণী, শিশু-বয়োবৃদ্ধরাও।

নববর্ষ ও বাঙালি জাতি যেন মিলেমিশে একাকার। নববর্ষ বাঙালির আত্মার উৎসব। বাংলার প্রতি ঘরের কোনে নবর্বষের দিনে ঘটে আলোকের ঝর্ণাধারার আগমন। অতীতের আত্মগ্লানি দুঃখ অন্ধকার অকল্যাণ মুছে নিজেদের মঙ্গল কামনায় গুণ গুণ করে গেয়ে উঠে ‘'তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে’।

বাংলা পঞ্জিকার নতুন সন ১৪২৯-এ বাঙালির জীবনে আনন্দধারা বয়ে ‍আসুক। সঙ্কীর্ণতা, জীর্ণতা, অন্ধকার কালিমা মুছে গেয়ে উঠুক নতুনের জয়গান। মঙ্গলময় বার্তায় ছেয়ে যাক গোটা ধরণীতল, ভরে উঠুক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে - শুভ নবর্বষ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর