কাচের জানালা পাখিদের মৃত্যু ফাঁদ, সমাধানে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা!

, ফিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 08:56:16

আধুনিক নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম উপাদান কাচ। ঘরে দিনের আলো প্রবেশের জন্য কাচ ছাড়া বহুতল ভবন কল্পনা করাই যায় না। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে কাচের দেওয়াল পাখিদের জন্য মৃত্যু ফাঁদ। কারণ মানুষ পরিষ্কার কাচকে যেভাবে দেখে পাখি ঠিক সেভাবে দেখে না। তাই কাচের দেওয়ালের সাথে সংঘর্ষে মারা পড়ছে অনেক পাখি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কাচের দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রতিবছর এক বিলিয়ন পাখি মারা যায়! আর এই হতাহতের ঘটনা বিষক্রিয়া, যানবাহনের সাথে সংঘর্ষ বা অন্যান্য কারণে মৃত্যুকে সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।

নিউইয়র্কের পাখি রক্ষাকারী সংস্থা NYC Audubon-এর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর ৯০ হাজার থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার পাখি নিউ ইয়র্কের কাচের তৈরি ভবনের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মারা যায়। শহরের আলোকিত ভবনগুলোর ঘনত্ব পাখিদের জন্য বিপজ্জনক। বিশেষ করে বসন্ত এবং শরত্ ঋতুতে।

নিউইয়র্কে পরিযায়ী  পাখিরা তাদের শীতকাল কাটায়। পাখিদের কৃত্রিম রাতের আলো  আকর্ষণ করে এবং বিভ্রান্ত করে। তারা বিশ্বাস করে আলোর দিকে উড়ছে, পাখিরা ঘুরে বেড়ায় এবং বাধা পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে মারা যায়।


NYC Audubon জীববিজ্ঞানী Kaitlyn Parkins বলেছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হল প্রতিফলিত কাচ।কাচের দেওয়ালে গাছপালা এবং আকাশের যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তা পাখিরা বাস্তব মনে করে। মুক্ত আকাশে পাড়ি দিতে কাচের দেওয়াল ভেদ করে সেখানে যেতে চায়। তারা দ্রুত স্থানান্তরে হতে যায়  এবং মারা পড়ে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে পাখির সংঘর্ষের বেশিরভাগ গবেষণা করা হয়েছে। দেশটির কাচের ভবনগুলোতে ধাক্কা খেয়ে প্রতি বছর ১ বিলিয়ন পর্যন্ত পাখির মৃত্যু হয়।

পাখি বিশারদ ড্যানিয়েল ক্লেম ১১৯০ দশকে এ বিষয়ে একটি গণনা করেছিলেন৷ তার গণনায় কাঁচের জানালা সারা বিশ্বে মৃত্যুফাঁদ বলে জানা যায়।

ক্লেম বলেছেন, ‘পাখি এবং কাঁচ যেখানেই একসাথে পাওয়া যাবে  তা পাখির ঝুঁকিপূর্ণ। তারা রক্তাক্ত জিনিস দেখতে পায় না। তিনি আরও যোগ করেন, আকাশচুম্বী অট্টালিকা নয় বরং নিচু এবং মাঝারি আকারের বিল্ডিংগুলি সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ।


সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিজ্ঞানী ‘পাখি মারা’ যাওয়ার কারণ হিসেবে কাচের জানালাকে গ্রহণ করেছেন। বিনবিন লি চীনে উইন্ডো স্ট্রাইক পর্যবেক্ষণকারী দুটি গ্রুপের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ডিউক কুনশান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিউকে পিএইচডি লাভ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি প্রকল্পের শীর্ষস্থানীয় গবেষকের সাথে দেখা করেন।

বিনবিন লি বলেন, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এটি শুধুমাত্র ডিউক বা রাজ্যের সমস্যা।কিন্তু আমি চীনে এই পরিসংখ্যান দেখে অবাক হই। এক মাসের মধ্যে সুজো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তিনটি মৃত পাখির সন্ধান পাই। এবং পাখিগুলো কাঁচের করিডোরের নিচে পাওয়া যায়।

পরে এই সমস্যার একটি পরিষ্কার চিত্র পেতে লি একটি জাতীয় জরিপ শুরু করেন। তিনি চীনে তিনটি প্রধান মাইগ্রেশন রুট বের করেন। তবে এই রুটগুলিতে প্রাণহানির তথ্য এখনও সীমিত। লি এ বিষয়ে বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছি   কাচের দেওয়ালে পাখির ধাক্কা খাওয়ার বিষয়টি চীনে সুপরিচিত নয়, এমনকি একাডেমিয়াতেও নয়।

'শুধু কাচ পরিবর্তন করুন এবং লাইট বন্ধ করুন'

আট বছর আগে পিএইচডি ছাত্রী হিসাবে  কাচের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে কোস্টারিকার রোজ মেরি মেনাচোকে তার অধ্যাপকদের বোঝাতে হয়েছিল। রোজ মেরি বলেন, তারা এই বিষয় সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন না। তবে একটি বাস্তব সমস্যা ছিল। এমনকি  এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে আমিও একটু বিব্রত ছিলাম।কারণ আমি ভেবেছিলাম এটি এত বড় বিষয় নয়।


তিনি গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে সমস্যার মাত্রা বোঝার জন্য প্রায় ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে কাজ করেন৷ এদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ফ্রিজে পালকযুক্ত মৃতদেহ সংরক্ষণ করে। আবার কেউ প্রতিবেদন এবং ছবি পাঠায়।

রোজ মেরি বলেন, শুধু পরিযায়ী প্রজাতির পাখির সংঘর্ষই নয়। তার স্বেচ্ছাসেবকরা প্রাণবন্ত রঙিন কুয়েটজাল এবং চকচকে বড় আকারের ঠোঁটসহ টোকান উদ্ধার করেছে। উভয়ই স্থানীয় প্রজাতির।

ব্রুকফিল্ড প্লেসের সামনে ফুটপাতে, ম্যানহাটনের দক্ষিণ প্রান্তে এ বিশাল অফিস এবং শপিং সেন্টার রয়েছে। রব কুভার  প্রতিদিন এসব স্থানে পাখি মারা যাচ্ছে কিনা এসব পরিদর্শন করেছেন।।  কভার একবার একক সকালে ২৭টি পাখি খুঁজে পেয়েছিল। একজন সহকর্মী স্বেচ্ছাসেবক গত সেপ্টেম্বরে এক ঘণ্টায় ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের চারপাশে ২২৬টি প্রাণহীন পাখি উদ্ধার করে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন।

রব কুভার বলেন, এই সমস্ত মৃতদেহ পাওয়া বেশ হতাশাজনক। কখনও কখনও তিনি জীবিত পাখিও খুঁজে পেয়েছেন। তবে সেগুলো আহত।

যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায়, স্বেচ্ছাসেবকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন পাখি রক্ষা বেশ সক্রিয়। স্থানীয় সরকার বিল্ডিং থেকে পাখিদের রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন করছে। অলাভজনক আমেরিকান বার্ড কনজারভেন্সির মতে, নিউইয়র্কের আইন সবচেয়ে কার্যকর।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে পাখির সংঘর্ষ বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা করে ড্যানিয়েল ক্লেম। এখন তিনি বেশ আনন্দিত। তিনি  ক্রমবর্ধমান সচেতনতা দেখে বেশ আশাবাদী, কারণ এটা তার চাওয়া ছিল।

ড্যানিয়েল ক্লেম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনও একটি অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা। তবে এসব সমস্যা সমাধান করতে কিছুদিন সময় লাগবে। কিন্তু পাখির সংঘর্ষ, এটি এমন সমস্যা যা আমরা আগামীকাল সমাধান করতে পারি। এটি জটিল নয়; আমাদের কেবল ইচ্ছা থাকতে হবে।

সূত্র: ডয়েচে ভেলে

এ সম্পর্কিত আরও খবর