দুর্যোগের সন্ধিক্ষণে হাওরাঞ্চল!

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 07:27:43

সবার চোখ এখন বিপন্ন হাওরাঞ্চলের দিকে। মিডিয়ার ফোকাসে দেখা যাচ্ছে ডুবন্ত হাওরের ক্রন্দনরত কৃষকের করুণ চেহারা। চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে মাঠের সোনালী ফসল। হা-হুতাশ, হতাশার মধ্যেই রাত জেগে চলছে পাহারা। তবুও বাঁধ রক্ষা করা যাচ্ছে না। কৃষকরা সর্বশক্তি দিয়ে ফসল, জীবন, বাঁধ ঠেকানোর লড়াই করছেন বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিয়দাংশ নিয়ে বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে।

চলতি চাষের মৌসুমে কৃষকরা প্রস্তুত ছিলেন, আশায় বুক বেঁধেছিলেন ফসল ঘরে তুলতে। গোলা ভরা থাকবে ধানে। মুখে থাকবে হাসি। সব যেন চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে। সব হারানোর ভয়ে এখন জীবনের কঠিন রণাঙ্গনে সঙ্কুল পরিস্থিতি পাড়ি দিচ্ছেন হাওরের সংগ্রামী কৃষকগণ।  

হাওরাঞ্চলকে বলা হয় ফসলের ভাণ্ডার। প্রধানত একটিই ফসল হয় হাওরে। আর সেটি হচ্ছে বোরো ধান। প্রথাগতভাবে হাওরের আদিঅন্তহীন মাঠে বৈশাখে কাটা হয় সেই ধান। অথচ হাওরের এই ফসল নিয়ে প্রতি বছরই থাকে শঙ্কা। আকস্মিক বৃষ্টি, বন্যা ও উজানের ঢলে তলিয়ে যায় হাওরের সবকিছু। তখন জমিজমা, ফসলের মাঠ ভাসিয়ে ধাবমান জলস্রোত বাড়িঘর ও জনবসতিকে ভাঙনের মুখোমুখি করে। 

এরূপ বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেই শত আশঙ্কায় চলে হাওরের জীবন ও চাষাবাদ। সংগ্রামী কৃষকগণ বৈশ্বিক মহামারিকালে আর্থিক সঙ্কট কাটাতে এ বছর আপ্রাণ পরিশ্রমে উৎপন্ন করেছিলেন যে ফসলের সম্ভার, তা পরিপক্ব হওয়ার আগেই তলিয়ে গেছে আগাম বন্যার পানিতে। ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ। দোকান, বাজার, বাড়ি, স্কুল, সবকিছু। চারিদিকে সমুদ্রের জলকল্লোলে মধ্যে অসহায় দ্বীপের মতো ভয়ে কম্পমান এখন হাওরাঞ্চল ও এর মানুষজন।

অথচ প্রতি বছরই সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে হাওরে বাঁধ দেয়। এবারও হাওরাঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের জন্য হাওরের প্রতিটি জেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল কমপক্ষে ১২০/১৫০ কোটি টাকা করে। এমন তথ্য পাওয়া গেছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিয়দাংশ নিয়ে থেকে। যেখানে সব মিলিয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার সরকারি উন্নয়ন কাজ হয়েছে। তারপরের বাঁধ টিকে নি। হাওরের মানুষ, ফলস ও সম্পদ রক্ষা পায় নি। 

মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে বিপন্ন কৃষকগণ বলেছেন, 'এবারো হাওরে সরকারের শতকোটি টাকা তলিয়ে গেল পানিতে। এই টাকায় কাজ কিছুই হলো না। বরং পানিভর্তি হাওরে বাঁধ এখন কৃষকদের কাছে চোখের বালি।'

প্রশ্ন হলো, হাওরের বাঁধ কেন কোনও কাজেই আসছে না? স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যানুযায়ী, হাওরে বাঁধ নির্মাণে সব সময়ই সীমাহীন দুর্নীতি হয়, এবারও হয়েছে। কাজ হয়েছে নিম্নমানে। টাকা লুটপাট করা হয়েছে। রাজনীতি ও প্রভাবের খেলায় টাকার বাটোয়ারা হয়েছে বলে বাঁধের কাজ মানসম্মত হয় নি। যার কুফল ভুগছে হাওরের মানুষ। হারাচ্ছে ফসল ও সহায়-সম্পদ।  

সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তি একাধিক মিডিয়া জানিয়েছে যে, প্রায় ১০ দিন আগে হঠাৎ করে ভারতের মেঘালয় থেকে ঢল নামে। এতেই ভীতির সঞ্চার হয় হাওরে।  তখন সুনামগঞ্জে সুনামগঞ্জ সফর করেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রীও। সফরকালেই তিনি সচক্ষে বাঁধের অবস্থা দেখে যান। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন কৃষকরা। ধর্মপাশায় এক কৃষক প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে বাঁধ নির্মাণের সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন জনতা। ওই কৃষক তার কাঠগড়ায় দাঁড় করান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করায় ওই কৃষকও পরে নেতাদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। তবে- পানি সম্পদ উপমন্ত্রী সুনামগঞ্জে বসেই বাঁধের অনিয়ম পাওয়ায় ঢাকায় গিয়ে অতিরিক্ত সচিব দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটিও পরপরই সুনামঞ্জ সফর করে গেছেন। কৃষকরাও তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি ঘুরে যাওয়ার দু’দিন পর পানি মন্ত্রণালয়ের সচিবও সুনামগঞ্জ ঘুরে যান।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কিছুটা ছলনার আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা বলছেন, এক তৃতীয়াংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এদিকে সুনামগঞ্জ সফর করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে হাওরে ধান কাটার উদ্বোধন করেন। তার উদ্বোধনের দু’দিনের মাথায় ডুবে যায় পুরো হাওর। আর বাঁধ নিয়ে টেনশনে থাকেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। 

হাওরের অন্যান্য জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, হাওরের শ’ শ’ একর ধান এখন পানির তিন থেকে চার ফুট নিচে। এখনো ধান কাটার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু তার আগেই হাওর তলিয়ে গেল। আর ক্রমাগত পানি বাড়ার কারণে তারা আর ধান কাটতে পারবেন না। 

দুর্নীতি ও তসরুপের মাধ্যমে টাকা লুটপাটের ঘটনায় হাওরের বাঁধ নির্মাণ নিম্নমানের হওয়া একটি পুরনো সমস্যা। সরকার বদল হলেও বাঁধ নির্মাণের অনিয়মের অবসান হয় নি। তদুপরি হাওরে দুর্নীতি করাও সহজ। কারণ, যত নিম্নমানের কাজই হোক, তা প্রমাণ করা কঠিন। অসৎ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারগণ সব দোষ দেয় ঢলের পানিকে। পানিতে ভেসে গেলে বাঁধ নির্মাণের ভালোমন্দ প্রমাণ করার সুযোগ থাকে না। বছরের পর বছর প্রকৃতিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেই রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে হাওরের দুর্নীতিবাজ চক্র।   

হাওরের দুর্নীতির পাশাপাশি বিপদ বাড়িয়েছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। হাওরের ভূপ্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের বারোটা বাজিয়ে চলছে সরকারি ও বেসরকারি কাজকর্ম,  যার কুফল দেখা যাচ্ছে হাওরের নানা ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য,  হাওরের সব নদ-নদীর পানির প্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য হাওর এলাকায় নতুন করে আর কোনও সড়ক নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রয়োজনে ওইসব এলাকায় এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ করা হবে। গত সোমবার (১৮ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বৈঠকের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে হাওর এলাকাতে কোনও রকমের রাস্তাঘাট এখন থেকে আর করা যাবে না। এখন থেকে এলিভেটেড করতে হবে, যদি কিছু হয়। যাতে করে পানি চলাচলে বাধা না আসে।  হাওরের বুকে কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকে মিঠামইন হয়ে অষ্টগ্রাম পর্যন্ত সড়কের কারণে বর্ষায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এখন ওই সড়কে সেতুর সংখ্যা বাড়িয়ে পানি প্রবাহ বাড়ানো যায় কিনা, সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, পারটিকুলারলি এটা দেখতে বলা হয়েছে, সিলেটের (অঞ্চল) পানিটা মূলত নামে অষ্টগ্রামের দিক দিয়ে। এখানে যে রাস্তাটা করা হয়েছে মিঠামইন থেকে অষ্টগ্রাম, সেটাতে কোনো অ্যাফেক্ট হলো কিনা- এটাও দেখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এ বিষয়ে সমীক্ষা চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর দেড়শ’ থেকে দুইশ’ মিটার ব্রিজ করে দেয়া যায় কিনা। এখানে এখনো ব্রিজ আছে, তারপরেও তাদের সার্ভে করতে বলা হয়েছে। এই সড়ক যেটা তারা করেছে, সেটার কারণে পানি যদি আটকে যায়, তাহলে তারা প্রেফারেবলি আধা কিলোমিটার বা আরেকটু লজিক্যাল ডিসটেন্সে, যদি মনে করে যে, এই সড়কটা পানির জন্য বাধা, তাহলে যাতে পানির ফ্লো ঠিক হয়- এ জন্য পর্যাপ্ত ব্রিজ করে দেয়া যায় কিনা, সেটা তারা ঠিক করবে। উজানের ঢলে এবার সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় অন্তত পাঁচটি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিপুল জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

সে প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বছরে প্রায় ৫ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ওই এলাকায়। কিন্তু ১ থেকে ৬ই এপ্রিল হয়েছে ১২০০ মিলিমিটারের বেশি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপর (উজান) থেকে পানি চলে এসেছে। প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর চাষ হয়। যদি আর বৃষ্টি না হয়, তাহলে ভালো অবস্থায় থাকবে। আগামী কয়েক দিন বৃষ্টি না হলে নতুন করে হাওরে ক্ষতি হবে না আশা প্রকাশ করে সচিব বলেন, হাওরে ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে মোটামুটি সব ধান কাটা হয়ে যায়, এদিকে একটু দেরিতে হয়। হাওরে এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের প্রথমেই পানি চলে আসে, এটা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আগামী ৮-১০ দিন যদি বৃষ্টি না হয়, আশা করা যায়- কোনো ক্ষতি হবে না। 

আগাম জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে হাওরে ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে এখানে আর্লি ভ্যারাইটি করা যায় কিনা, যাতে করে এপ্রিল মাসের ১০-১২ তারিখের দিকেই ধান কেটে ফেলা যায়। রোববার (১৭ এপ্রিল) মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাঁধ নির্মাণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কথা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী অনুরোধ করেছেন, যে বাঁধগুলো দেয়া হয়েছে, সেগুলো ফ্রুটফুল কিনা বা কোয়ালিটি ঠিক আছে কিনা- এটা দেখতে। এই বর্ষায় তো আর কিছু করা যাবে না। আগামী বর্ষার আগে যেন এটা রিভিউ করে সমাধান করা হয়। আলোচনা হয়েছে যে, নদী-নালা ও হাওরে যেখানে বেশি পলি পড়ে গেছে, সেগুলোকে পুনঃখনন করে আগামী বর্ষার আগেই প্রকল্প শুরু করে কাজ নেয়ার জন্য। রিসেন্টলি একনেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প পাস হয়েছে, সেটি সুনামগঞ্জ থেকে আসবে, সেটিও এলিভেটেড হচ্ছে। শুধু হাওর না যেসব এলাকা লো লাইন এলাকা, সেগুলোতে যত সড়ক হবে সেগুলো এলিভেটেড হবে।

প্রতিবছরের মতো এবারও দুর্যোগের সন্ধিক্ষণে হাওরাঞ্চল। সরকার নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে হাওরের কৃষক ও ফসল রক্ষার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু হাওরের বিপদ ও দুর্যোগের স্থায়ী অবসানে টেকসই পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রয়োজন। প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে  'হাওর নীতিমালা' প্রণয়ন করে সেখানে নির্মাণ, উন্নয়ন, ভূমির ব্যবহারকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং হাওরের সামগ্রিক বিশিষ্টতা অক্ষুণ্ণ রেখে হাওরবাসীর নিরাপত্তা ও কল্যাণ সুনিশ্চিত করা। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর