ভীষণ সাহসী আর লড়াকু পাখি ‘কালো ফিঙে’

, ফিচার

বিভোর বিশ্বাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 04:26:11

যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় – আমাদের প্রতিবেশী এবং আমাদের চিরচেনা পাখি কোনোটি? তবে খুব সহজেই ‘কালো ফিঙে’ পাখির নাম চলে আসবে। কারণ, সে আমাদের চারপাশেই থাকে। এদিক-সেদিক চোখ মেললেই এই পাখিটির দেখা মেলে। প্রতিনিয়তই সে ঘুরে বেড়ায় আমাদের বাসা-বাড়ির সামনে, বৈদ্যুতিক তারে, বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেতে, ছোটখাটো ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে বনপাহাড়ে। কোথায় নেই সে!

২৮ সেন্টিমিটারের চকচকে কালো দেহের ফিঙের ইংরেজি নাম Black Drongo এবং বৈজ্ঞানিক নাম Dicrurus macrocercus। কালো ফিঙে তুখোর লড়াকু পাখি। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা এই পাখিটিকে ‘পাখির রাজা’ বলে থাকেন। কালো ফিঙে ছাড়াও এই পাখিটিকে কালা ফিঙে, ফেউচ্চা, হেচ্চোয়া প্রভৃতি অনেকে বলে থাকেন।

বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী আবু বকর সিদ্দিক এর তোলো বিশেষ এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি কালো ফিঙে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছি তার থেকে কয়েকগুণ বড় ভূবন চিল (Black Kite) পাখিকে। এর থেকেই বুঝা যায় কালো ফিঙে দৈহিক গঠনে ছোট হলেও সে প্রচন্ড সাহসী।

দুর্বল পাখিদের রক্ষক এবং খুব সাহসী পাথি কালো ফিঙে। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

বাংলাদেশের প্রখ্যাত পাখি গবেষক, লেখক এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, অনেক সাহসী পাখি কালা ফিঙে। কারণ, হলো সে অনেক বড় পাখিকে তাড়া করে থাকে। ও যে এলাকায় থাকে ওর থেকে দশগুণ বড় এবং ওজনে বিশগুণ বড় পাখিকে সে সবসময় তাড়া করে সরিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে ও যদি বাসা করে তখন সব পাখিকেই সে তাড়া করে। শুধু তাড়া করলেই হয় না; তাড়া করে সে জিতেও যায়।  তাতে কি হয় – ওর আসেপাশে অন্য দুর্বল পাখিরা যেমন-বুলবুল, ঘুঘু ওরা বাসা করে। কারণ ওরা জানে এখানে কোনো শত্রু আসবে না। কালাফিঙে এত্ত ভয়ংকরভাবে তাড়া করবে যে, বিড়াল-কুকুর পর্যন্ত ওর তাড়া খেয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য।

শিকার হিসেবে টিকিটিকি কে ধরেছে সে। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

ফিঙে এবং শিকারী পাখিদের বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘এটার বড় কারণ হলো- কালা ফিঙের নখরগুলো খুব তীক্ষ্ম। সাধারণত আপনি দেখবেন- শিকারি পাখিগুলোর নখ খুব তীক্ষ্ম ও শক্তিশালী হয়। কালাফিঙে কিন্তু শিকারী পাখি নয়। ও তো মুখ দিয়ে শিকার ধরে। শিকারী পাখি হলো যারা পা দিয়ে শিকার ধরে খায়। আমাদের দেশের শিকারী পাখিরা হলো- ঈগল, বাজ, চিল, পেঁচা প্রভৃতি। এদের পায়ের নখর অত্যন্ত শক্ত। আপনি এদের হাত দিয়ে ধরলে এদের কামড়ে আপনার ক্ষতি হবে না, কিন্তু সে যদি নখর দিয়ে আপনাকে ধরে তাহলে আপনার হাতের চামড়া ছিড়ে যাবে। ফিঙে শিকারী পাখি নয়, কিন্তু ওর নখর অত্যন্ত শক্তিশালী। ওইজন্যে ওর একটা বড় সুবিধে আছে- ও যদি তাড়া করে পায়ের নখ দিয়ে ধরে তাহলে বড় পাখিদের বড় ক্ষতি করে ফেলবে। তাই তারা ফিঙের তাড়া খেয়ে পালায়।’

কালো ফিঙের উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

ইনাম আল হক আরো বলেন, ‘ফিঙের ঠোঁটেও শক্তি আছে; আর নখে তো আছেই। আমরা যেহেতু পাখিগবেষণার কাজে ওদেরকে ধরি তাই আমরা এ সম্পর্কে ভালো জানি। ফিঙে ধরলেই হাত রক্তাক্ত হয়ে যাবে। কিংবা একটা বুলবুল ধরলে বা ঘুঘু ধরলে কিছুই হবে না। কারণ তাদের পায়ে নখরের শক্তি নেই। ফিঙে ধরলেই খুব সাবধান থাকবেন- একদম ছিঁড়ে ফেলবে আপনার হাত। আপনার হাতের মাংসের মধ্যে তার নখ ঢুকে গেলে বের কথা কঠিন হবে এবং সে একমুহুর্তেই ওর তীক্ষ্ম নখর আপনার হাতের ঢুকিয়ে ফেলবে।’

`তীক্ষ্ম, শক্তিশালী এবং সরু নখরের অধিকারী বলেই ফিঙে বহু বড় বড় পাখিকে তাড়া করে পশুকেও ক্ষতবিক্ষত করতে পারে। তাই সবাই ভয় পায় ওকে। ফলে ফিঙে যেখানে বাসা করে ওর আসেপাশে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পাখিরাও লুকিয়ে বাসা করে। কিন্তু ফিঙে প্রকাশ্যে মাচায় বাসা করে। ফিঙের বাসা দেখবেন খোলা জায়গায় হয়ে থাকে। কারণ ও কাউকেই ভয় পায় না। রাত্রিবেলা নিশাচর প্রাণী যেমন- গন্ধগোকুল, সাপসহ অন্যপ্রাণীরাও ওর বাসায় দিকে আসলে তাদেরও সে তাড়া ভীষণভাবে করতে ভয় পায় না।'

গ্রামাঞ্চলের মানুষ কিন্তু ফিঙে পাখিকেই ‘পাখির রাজা’ বলে থাকেন। কারণ মানুষ দেখেছে যে- ফিঙে তার থেকে অনেক বড় পাখিদের তাড়া করে নিয়ে যেতে সক্ষম। তাই তার সাহস থেকে এমন নামটি দেয়া। আবার অন্য পাখিরাও এটা ভালই জানে যে, ফিঙে আসেপাশে থাকলে নিরাপদে থাকা যাবে বলে জানান প্রখ্যাত পাখি বিজ্ঞানী ইনাম আল হক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর