উপকূলীয় এলাকা রক্ষার্থে বনের গুরুত্ব অপরিসীম

, ফিচার

আবু হাসনাত তুহিন | 2023-09-01 17:02:16

আমরা প্রায়শই নদীর তীরবর্তী কিংবা সমুদ্রের তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকাগুলোকে বছরের বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, টর্নেডোসহ নানারকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে দেখি। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার বাড়িঘর, আশেপাশের ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় উপকূলীয় বনগুলো।

আমরা সবাই জানি, একটি দেশের আয়তনের তুলনায় ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান বনভূমির পরিমাণ দেশের আয়তনের প্রায় ১৫.৫৮%। বন অধিদপ্তরে রক্ষিত ২০১৮-২০১৯ এর হালনাগাদ তথ্যানুসারে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ২৫,৭৫,১৯৬.০১ হেক্টর(গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনুসারে) যা দেশের মোট আয়তনের তুলনায় ১৭.৪৫%। তবে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ১৮,৮০,৪৯৩.৭৩ হেক্টর(গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনুসারে) যা দেশের মোট আয়তনের তুলনায় ১২.৭৪৩%। ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু তারতম্যের কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম-পাহাড়ি বন, প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন, সৃজিত উপকূলীয় বন, শালবন, জলাভূমির বন ইত্যাদি। দেশের জলবায়ু, উপকূলীয় এলাকা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এসব বনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তন্মধ্যে সৃজিত উপকূলীয় বন ও প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোর বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে।

দেখা যায়, গভীর নদী বা সমুদ্র উপকূলের রয়েছে প্রবল ঢেউ। ঢেউগুলো এতই প্রবল হয় যে, চারপাশে এলাকায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে জলোচ্ছ্বাসের আকার ধারণ করে। ফলে উপকূলের আশেপাশের বনে আঘাত হানে। বনের বৃক্ষগুলোর শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রেখে ভাঙ্গন রোধ করে। ফলে ভাঙ্গন বেশি বিস্তৃতি লাভ করে উপকূলের জনপদে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এসব বন না থাকলে উপকূলবর্তী এলাকার জনপদে সময়ে-অসময়ে নেমে আসত চরম দুর্ভোগ।

উপকূলীয় এলাকায় নদীভাঙ্গন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বছরের বিভিন্ন সময়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় লাখ লাখ হেক্টর জমি। বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষাকালে উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুণ নদীর পানি বেড়ে যায় এবং তা প্রচন্ড গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের নদীসংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র তোড়ে সৃষ্টি হয় নদীভাঙনের। বাংলাদেশে এটা স্বাভাবিক চিত্র হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আর স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হচ্ছে না।

প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে। এই ভাঙনের ফলে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙনের ফলে এদেশে প্রতিবছর ২৫ কোটি ডলার ক্ষতি হয়।

এক্ষেত্রে ভোলা জেলাকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (CEGIS) উপগ্রহের মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে যে, ১৯৭৩-২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভোলার মূল ভূভাগ থেকে ২৪০ বর্গ কিলোমিটার জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপগ্রহচিত্রে দেখা যায় ভোলার উত্তর-পূর্ব দিকে ভাঙনের প্রবণতা বেশি। তবে নদীভাঙ্গনের সাথে সাথে চরও জেগে উঠে যা ভাঙ্গনের তুলনায় যৎসামান্য।

তাই আমাদের বেশি করে উপকূলবর্তী এলাকায় বিশেষ করে নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় সৃজিত উপকূলীয় বনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। জেগে উঠা চরে বেশি বেশি বন সৃজন করে চরভূমিকে স্থিতিশীল ও দৃঢ় করে কৃষি কাজসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। পশ্চিম উপকূলীয় ৩টি জেলা- খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় অবস্থিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। কারণ এই বন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা হতে উপকূলীয় এলাকা তথা সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলকে রক্ষা করে। বন অধিদপ্তরকেও এক্ষেত্রে উপকূলীয় এলাকার গতিশীলতা আনয়নে বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বনজ সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন ও বন সম্পসারণে এগিয়ে আসতে হবে।

আবু হাসনাত তুহিন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আইন ও ভূমি প্রশাসন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর