ভাঙনে, স্রোতে, গতিতে ও সংহারে 'সর্বনাশা পদ্মা' নামের পরিচিতিতে গানে, কবিতায় ও বাঙালি জনজীবনে চিত্রিত প্রমত্তা নদীতে এখন ঐতিহাসিক সেতু। ইতিহাস নির্মাণের এমন 'টার্নিং পয়েন্ট'-এ পদ্মা সেতুর তীরে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের বহুল চর্চিত কবিতাকে একটু বদলে নিজেদের মতো করে লেখার সাধ জাগতেই পারে বাংলাদেশের স্বপ্ন-সফল মানুষের। সম্মিলিত কণ্ঠের আবাহনে সবাই বলতেই পারে: "পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/'আমরা সবাই উন্নয়নের' পন্থী।"
আদিতে রোমান্টিক আবহে রচিত 'শেষের কবিতা'য় চরণগুলো রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শেষ বয়সে আধুনিক মনন আর অগ্রসর প্রেমের শৈলীতে রচিত 'শেষের কবিতা'কে রবীন্দ্রনাথের রচনা সমগ্রের মধ্যে 'বিশেষ' ও 'আলাদা' বৈশিষ্ট দিয়েছে। কেটি মিত্তির, অমিত রয়ের বিন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
"পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।/রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল/পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,/ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে/দিগঙ্গনার নৃত্য;/হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে/ঝলমল করে চিত্ত।"
পদ্মা সেতু শুধু পথই বেঁধে দেয় নি, হঠাৎ আলোর ঝলকানি লাগিয়ে সারা জাতির চিত্ত ঝলমল করে দিয়েছে। এক অসম্ভব রকমের ব্যয়বহুল ও অকল্পনীয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের সভ্যতার ইতিহাস-মুকুটে স্বর্ণ পালকের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে পদ্মা সেতু।
নদী-বিঘ্নিত বাংলাদেশকে সহস্র বর্ষের পরিক্রমায় এক ও অভিন্ন সত্ত্বায় আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছে পদ্মা সেতু। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ বাংলাদেশের সংযোগ ও যোগাযোগের স্বপ্নময় সরণি উন্মোচিত হয়েছে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। দুর্লঙ্ঘ পদ্মার বুক পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালি এক ও একাকার হতে পেরেছে মৈত্রী, মিলন, আন্তঃসংযোগের মসৃণ আবহে।
যে কর্মযজ্ঞ আর চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবের মোহনায় পৌঁছেছে, তা এক মহাসমর তুল্য আখ্যান। নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, সাহস ও কমিটমেন্টের দ্বারা ভেতরের ও বাইরের শাঠ্য-ষড়যন্ত্র-বিঘ্ন গুড়িয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে জয় হয়েছে বাঙালি জাতির অকুতোভয় ও অদম্য স্পৃহার। পৃথিবীর আশ্চর্য ও উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ও নির্মাণশৈলীর তালিকায় স্থান লাভকারী পদ্মা সেতু বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার সৃষ্টি ও বিকাশ চেতনার অনুকরণীয় 'আইকন' আজ।
পৃথিবীর বুকে সভ্যতার ইতিহাস হলো বিঘ্ন, বিপদ ও দুর্গমতাকে জয় করার ইতিবৃত্ত। সেতু সেই ইতিহাসকে সহজ করেছে অজানা ও অচেনাকে কাছে এনে এবং সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মোচিত করে। সেতু, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্রিজ, তা হলো, যেকোনো প্রকারের প্রতিবন্ধক অতিক্রম করার জন্য প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে গঠিত সংযোগ। একটি সেতুর নকশা ও নির্মাণশৈলী নির্ভর করে তার প্রয়োজনীয়তা, নির্মাণস্থলের প্রাকৃতিক অবস্থান, ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রী এবং বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণের উপর।
যাবতীয় সকল আয়োজন সম্পন্নকরণ ও বাস্তবায়ন সমাপ্তের পর নির্মিত সেতুর প্রভাবে বদলে যায় ইতিহাসের গতি ও সভ্যতার চাকা। কৃষি, পর্যটন, বিপণন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতিটি ক্ষেত্রে নবনির্মিতির উল্লাস বয়ে আনে সেতুর প্রসারিত দুই প্রান্ত। সেতু শুধু ভৌত কাঠামোর উন্নয়নপ্রবাহের মধ্যেই সীমিত থাকে না, আরও প্রসারিত হয়ে জাতির ঐক্য, সংহতি, শক্তির প্রতীকেও পরিণত হয়। চৈতন্য জাগ্রতকারী এক বাতিঘরের মতো বহুমাত্রিক আলোকমালার বিচ্ছুরিত বর্ণালীতে ঋদ্ধ করে জাতিসত্তার সমগ্র কেন্দ্র ও প্রান্তকে এবং প্রতিটি সদস্যকে।
ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বাংলাদেশ ও বাঙালির গৌরব ও অর্জনের মহত্তম সঞ্চয়কে আরও পরিপুষ্ট করার প্রত্যয়ে দীপ্ত। জীবন ও যাপনের, সমাজ ও অর্থনীতির, সংস্কৃতি ও লোকাচারের, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিটি ক্ষেত্রে পরম পরশে পদ্মা সেতুর স্পর্শ সমুদ্র-সমান সম্ভাবনার নতুন ইতিহাস রচনার তীব্র প্রতীতিতে দোলায়িত।
বৃহত্তর ঢাকা ও বৃহত্তর ফরিদপুরের জল ও স্থলরেখার বিভেদ ঘুচিয়ে পদ্মা সেতু যখন বাংলাদেশের মধ্য ও দক্ষিণাংশকে মিলিয়ে দেওয়ার স্মরণীয় ইতিহাসকে চুম্বন করছে, তখন সমগ্র বাংলাদেশ অন্তরের আলোয় দেখছে অনাগত সুন্দর ও সম্ভাবনার পথরেখা; প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে সমবেত আনন্দধ্বনিতে গাইছে: "পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, 'আমরা সবাই উন্নয়নের' পন্থী"।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।