দুপুর-রোদের তীব্রতা। চারদিক পুড়ছে। যেদিকে চোখ মেলে তাকানো যায় কেবল ফ্যাকাসে আভা। সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে রৌদ্রতাপে। বিখ্যাত জলাভূমি বাইক্কা বিলে দগ্ধতার জ্বালা। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় ‘ভুবন চিল’।
‘পাখি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার’টা আজ বেদনার স্মৃতি! কেননা ওখানে একজন পাখিপ্রেমী মানুষ ছিলেন। যার নাম মিরাশ মিয়া। তিনি কত্তশত পাখি চিনিয়েছিন মানুষদের! গত কয়েক বছর ধরেই মিরাশশূন্য পাখিরা।
বাইক্কা বিলে পাখিদের কথা বললেই অনায়াসে এসে যান তিনি। ভালোবাসা থেকেই হয়তো। এখনো স্পষ্টতই কানের গহ্বরে মৃদুমধূরতায় বাজে- ‘দেখুন দেখুন, এই যে ভুবন চিল’! হঠাৎ ওড়ে যাওয়া ভুবন চিলের দিকে পাখীপ্রেমী মিরাশ মিয়ার দৃষ্টিদান পর্ব। মাথার উপর দিয়ে ধীরে গম্ভীরভাবে তখন উড়ে যায় শিকারি ভুবন চিল।
ভুবন চিলের ইংরেজি নাম Black Kite এবং বৈজ্ঞানিক নাম Milvus migrans। এরা আমাদের দেশের তুলনামূলক বড় আকারের পাখি। এরা উড়ন্তভাবেও খাবার খেতে পারে। আগে থেকে শিকার ধরে যখন অনন্ত আকাশে ডানা মেলে, তখন উড়তে উড়তে তীক্ষ্ম নখে ধরে থাকা শিকার বা খাবারগুলো তার শক্তিশালী ঠোঁটের সাহায্যে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বলেন, ভুবন চিল Milvus গণের মাঝারি আকারের শিকারি পাখি। এদের ডানা দীর্ঘ ও সুচালো; তা লেজের আগা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তৃতীয় ও চতুর্থ পালক সবচেয়ে লম্বা। পা খাটো। পৃথিবীতে ২ প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে ১ প্রজাতি পাওয়া যায়।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইনাম আল হক বলেন, এ পাখিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬ সেন্টিমিটার। কালচে-বাদামি দেহ এবং ডানায় কালো ছোপ রয়েছে। পাখিটির লেজ লম্বা এবং মাছের লেজের মতো চেরা দেখতে পাওয়া যায়। লালচে আভা রয়েছে পেট ও লেজতলে। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় ডানার নিচের দিকের সাদা সাদা পট্টি চোখে পড়ে। হালকা হলুদ রঙের লম্বা পা এবং চোখ বাদামি।
এর প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, এরা আমাদের দেশের সুলভ আবাসিক পাখি হলেও শীত মৌসুমে বিপুল সংখ্যায় এদের পাওয়া যায়। এরা পর্বত, নদীর পাড়, বেলাভূমি নগর, শহর ও গ্রামে বিচরণ করে। সচরাচর ছোট দলে লোকালয়ে থাকে। এছাড়াও ভারত, ভূটান, নেপাল, শ্রীলংকাসহ ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
এদের খাদ্য-তালিকা সম্পর্কে এ পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, এরা বর্জ্যভুক পাখি। বর্জ্যস্তুপ, মাছের বাজারের উচ্ছিষ্ট ও ফেলে দেওয়া বর্জ্য অংশই খায়। প্রায়ই শকুনের সাথে মিলে উচ্ছিষ্ট কিংবা পশুর মৃতদেহ খেয়ে থাকে।
মার্চ-মে ভুবন চিলদের প্রজনন মৌসুম। তখন ছেলেপাখি আকাশের মাঝে চক্রাকারে উড়তে থাকে এবং হঠাৎই ঝাপ দিয়ে প্রেমময় অভিসারে ডালে বসে থাকা মেয়েপাখির পিঠে এসে নামে বলে জানান প্রখ্যাত পাখিবিদ ইনাম আল হক।