বাংলাদেশের পাখি তালিকায় যুক্ত হওয়া নতুন একটি পাখির নাম ‘উদয়ী জিরিয়া’। লম্বাপায়ের এ পাখিটি মূলত সৈকতপাখি। জলাভূমি আশপাশে আপনমনে ঘুরে বেড়ায়।
পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মহাশূন্যের ওপর দিয়ে উড্ডয়নকালে সে বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি নিয়েছি। বাংলার উপকূলে খাবার সংগ্রহ করে সে হয়তো আবার পাড়ি জমাবে কাঙ্ক্ষিত পথে।
উদয়ী-জিরিয়ার ইংরেজি নাম Oriental Plover বৈজ্ঞানিক নাম Charadrius veredus। সম্প্রতি পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে এ পাখির ছবিটি তুলে রেকর্ড করেছেন পাখি আলোকচিত্রী সুলতান আহমেদ।
তিনি বলেন, বছর তিন আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে কুয়াকাটায় গিয়েছিলাম একটি গবেষণার কাজে। পাখির দেখার অভ্যাস থেকেই কাজ শেষে দেখলাম বিচের মধ্যে কিছু বড়-ধুলজিরিয়া এবং ছোট ধুলজিরিয়ার ঝাক রয়েছে। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার সময় খেয়াল করলাম একটা পাখি একটু বড় লাগছে। সেই পাখিটা বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। পরে ঢাকায় এসে বার্ড বাংলাদেশ গ্রুপে ছবিটি আপলোড দিয়ে জানতে পারলাম এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন পাখি। নাম Oriental Plover (উদয়ী জিরিয়া)।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক, লেখক ইনাম আল হক বলেন, ‘এই উদয়ী-জিরিয়া পাখিটাকে প্রথম বাংলাদেশে দেখা গেল। এই পাখিটার জন্ম হয় চীন এবং মঙ্গোলিয়াতে। এই অঞ্চলে বাসা করে। অন্যান্য যেসব সৈকতপাখি আছে তারাও এই অঞ্চলে এবং সাইবেরিয়াতে বাসা করে। উদয়ী-জিরিয়া শীত কাটায় অস্ট্রেলিয়াতে। এর অর্থ হলো সে প্রতিবার চীন-মঙ্গোলিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়াতে যায় আবার ফিরে আসে। পথে কিন্তু পড়ে বেশির ভাগই থাইল্যান্ড, কিছুটা মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ খুব একটা পড়ে না। কিন্তু ওরা একেবারে সরু পথ ধরে যায় না; অনেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।’
এ গবেষক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জলাভূমিতে দেখা গেলো এই প্রথম। হয়তো বেশি দেখা যাবে না। কারণ, এই পশ্চিমে এরা কমই আসবে। মানে যেহেতু ওরা সময় পানির পাখি তাই চীন-মঙ্গোলিয়া থেকে অস্ট্রোলিয়া যাবার পানির পাশ দিয়েই যাবে। ওই হিসেবে বাংলাদেশ খুব একটা পড়বে না। তবু আমরা খুব খুশি হলাম জেনে যে, হয়তো দু-একবার দেখা যাবে এই পাখিটাকে।’
সে এখন যাত্রাপথে রয়েছে উল্লেখ করে ইনাম আল হক বলেন, উদয়ী-জিরিয়া এখন অস্ট্রেলিয়ার পথে রয়েছে। এভাবেই সে ধীরে ধীরে যায়। এক নাগাড়ে উড়তে পারে না। এখানে হয়তো ২-৪দিন খেলো। আবার একটু উড়ে পানির পাশের একটা জায়গায় চলে গেলো। ও কাঁদাপানির পোকা ধরে খায়। নদীর পাড়ে, সমুদ্রের পাড়ে এরকম করতে করতে এক সময় যে অস্ট্রেলিয়ার পৌঁছে যাবে। শীত পার হয়ে গেলে আবার সে অস্ট্রেলিয়া থেকে চীন-মঙ্গোলিয়ায় ফিরে আসবে।
‘পাখিদের এমন নয় যে - একেবারে একজনের পিছু পিছু আরেক জন যায় না। ওদের মাথার মধ্যে মুটামুটি কাঙ্ক্ষিত পথের একটা চিহ্ন থাকে। কিন্তু ওর একটু এদিক-ওদিক হয়ই। সেই জন্য আমরা ভাগ্যবান যে, একটু এদিক-ওদিক হওয়ার কারণেই এই প্রজাতির পাখিটিকে বাংলাদেশে দেখতে পেলাম।’
অভিযাত্রা এবং অবস্থান সম্পর্কে পাখি গবেষক ইনাম আল হক আরও বলেন, ওরা খুব বেশি একসাথে যায় না। দুই-চারটি বা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। এখানে তো একটাই মাত্র দেখা গেছে। হয়তো এর আশেপাশে আরও দু-একটা ছিল। কিংবা সে দলহারাও হতে পারে। কিছু দিনের জন্য ওরা দলহারাও হয়ে যায় অনেক সময়। দল থেকে ছুট হয়ে গেলে ওরা খুব একটা দুশ্চিন্তা করে না। শুধুমাত্র এদের দল লাগে রাত্রেবেলা ঘুমানোর জন্যে। অনেকে মিলে একত্রে না ঘুমালে শত্রুতে ধরে ফেলে। তাছাড়া দিনের বেলা ওরা একা একাই বেশিরভাগ সময় কাটায়। চিন্তা করে না যে অন্যরা কোথায়?
‘রাত্রে তাদের ঘুমানোর জন্য একটা জায়গা থাকে নির্দিষ্ট – ভৌগলিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই রাতের বিশ্রামের স্থানটি নির্বাচন করে ওরা। তখন দলটা এক হয়ে যায়। উদয়ী-জিরিয়া আবার অন্য একটা প্রজাতির সৈকতপাখিদের দলেও থাকতে পারে। ও যে শুধুমাত্র উদয়ী-জিরিয়া পাখিদের দলে থাকবে তাও নয়।’
উদয়ী-জিরিয়ার (Oriental Plover) গঠনশৈলী মোটামুটি আমাদের ছোট-নখজিরিয়ার (Little Ringed Plover) মতোই। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ থেকে ২০ সেন্টিমিটার। এর লম্বা পা দেখেই আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে- এটি তো আমাদের দেশে বিচরণকারী কোনো জিরিয়া নয়। অন্য জিরিয়াদের চাইতে পা অনেকখানি লম্বা বলে জানান প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক।