পর্যটন এলাকাগুলো ছাড়লে থাই জনগোষ্ঠীর ইংরেজি ভীতি উল্লেখযোগ্য। বরং কখনো ঔপনিবেশিক শাসনে না থাকায় ইংরেজিকে গ্রহণ করতে হয়নি বলে গর্বও করেন অনেকে। ফলে গত ১০ জুন যখন আমার স্ত্রী থাই পিবিএস টিভির সাংবাদিক কানালাওয়াই ওয়াক্লেহংকে ট্রাট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, আমার মৌখিক যোগাযোগেরও প্রায় সব পথ বন্ধ হয়ে গেলো। কম্বোডিয়া সীমান্ত ঘেষা ট্রাট থাইল্যান্ডের একটি বিভাগীয় শহর। বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতায় ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া হলেই ইংরেজিতে মৌলিক শব্দ নাগরিকরা বলতে পারেন। অথচ এখানে বিরাট সব ডিগ্রিধারী চিকিৎসক বা আইনজীবীর পেট চেপে ধরলেও অন্য ভাষা বের হবে না। এদিকে আমার শ্বশুরবাড়িতেও স্ত্রী ছাড়া কারো পক্ষে ইংরেজিতে যোগাযোগ অসম্ভব। আর আমার থাই ভাষার জ্ঞানও হাটু ভাঙ্গা। তাই আধুনিক সময়ে গুগল ট্রান্সলেটেই ভরসা করতে হয়।
ট্রাট হাসপাতালে এর আগে ৩১ মে এবং ৭ জুন এসেছিলাম স্ত্রীকে গর্ভাবস্থার পরীক্ষা করাতে। আমার স্ত্রী যখন সন্তান সম্ভবা হয় তখন আমরা বাংলাদেশে। আমার দেখামতে থাইরা পরিচ্ছন্নতার ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়। তাই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা সর্ম্পকে একটা পরিষ্কার ধারনা দেওয়ার জন্য তাকে পরীক্ষা করাতে ইউনাইটেড এবং ডাক্তার দেখাতে পরবর্তীতে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দুটো হাসপাতালেরই আঙ্গিনা দেখে স্ত্রী আমাকে বলেছিলো, ‘এতো নোংরা কেন তোমাদের হাসপাতালগুলো!’ এখানে মানুষ সুস্থ হয়ে আসলেও তো অসুস্থ হয়ে যাবে! আর ইউনাইটেডে ২ হাজার ১০০ টাকা ভিজিট দিয়ে যখন ৫ মিনিটের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিলাম, সেটা শুনে ও বললো, এমন জানলে থাইল্যান্ডের সব চিকিৎসকরাইতো বাংলাদেশে চলে আসবে!
ইউনাইটেড বা এভারকেয়ারকে নোংরা বলার কারণ খুঁজে পেলাম এখানে একটি বিভাগীয় হাসপাতালে এসে। সব মিলিয়ে মাত্র আড়াই লাখ মানুষের বাস ট্রাট বিভাগে। তবে প্রতিবেশী দেশের প্রতি দায়িত্ব হিসেবে এই সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে পারেন কম্বোডিয়ার সাধারণ জনগণও। যদিও এক্ষেত্রে তাদের স্থানীয়দের তুলনায় বাড়তি খরচ গুণতে হয়। তবে ট্রাট হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা দেখে আমি মনে মনে ভাবি, ভাগ্য ভাল স্ত্রীকে দেশের সরকারি হাসপাতালে নেইনি। নিলে হয়তো মূর্ছা যেতো!
২০০২ সালেই ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ গ্রহণ করে থাইল্যান্ড। এর ফলে স্থানীয়রা সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৩০ বাথ বা ৮০ টাকায় বাচ্চা জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারের চিকিৎসা পর্যন্ত হয়। শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ খরচ নয়, এই খরচে ওষুধ, পরীক্ষা এবং ডায়াগোনসিসের খরচও বহন হয়।
আমার স্ত্রী চাকরি সূত্রে থাকেন ব্যাংককে। এর আগে গত ডিসেম্বরে সেখানে চুলাবরন ক্যান্সার হাসপাতালে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গর্ভাবস্থার নিয়মিত চেক-আপে।
চুলাবরন হাসপাতালটি সরকারি হাসপাতাল নয়, বর্তমান রাজার বোন বা ভ্যালেড রাজকন্যার অনুদানে চলা একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেখানে ৮ মাস পর্যন্ত নিয়মিত চেকআপ করা হতো পে’র। সেখানে যে চিকিৎসক ছিলেন, ওয়টসিলা, প্রতিবার তার কাছে গেলে তিনি প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট গল্প করতেন। আমার অবস্থা, স্ত্রীর চাকরির অবস্থা, দেশের অবস্থা এসব নিয়ে। কারণ হচ্ছে একটাই, ডাক্তার হিসেবে রোগীকে আরও সহজ করা। চুলাবরনের চিকিৎসকই ৩২ সপ্তাহ হয়ে গেলে স্ত্রীর ফাইল ট্রাট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ইমেইলে। আমরা যখন হাসপাতাল থেকে বের হই দেশে, আমাদের হাত ভর্তি যেমন অনেক ফাইল আর টেস্টের ফলাফল থাকে, এখানে আমার স্ত্রী বা সন্তানের এখন পর্যন্ত কোন চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজ চোখে পড়েনি। কারণ সবই আছে হাসপাতালের নির্দিষ্ট সার্ভারে।
ট্রাট থাইল্যান্ডের ধনী প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি। এখানে মানুষের মাথাপিছু আয় থাইল্যান্ডের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় ভাল। তবে সেই অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক নেই। সরকারি হাসপাতালের বাইরে শুধু রয়েছে বেসরকারি ‘ব্যাংকক হাসপাতাল।’ যেহেতু পর্যটন স্থান হিসেবে ট্রাট পশ্চিমাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়, তাই তাদের জরুরি সেবা ও মেডিকেল ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করে এই বেসরকারি হাসপাতালটি। রয়েছে কয়েকটি ক্লিনিকও, সেখানে একজন বা দুজন করে চিকিৎসক রয়েছেন শুধু পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালের বাইরে একটিও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চোখে পড়েনি। আর প্রেসক্রাইবড ওষুধ নিতে হলেও শহরের ৫টি ফার্মেসির বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই।
ট্রাট হাসপাতালেও যখন স্ত্রী চেক আপে যেতো, এখানকার চিকিৎসক অনেকক্ষণ সময় দিতেন, গল্প করতেন। এতো সময় পেতেন কিভাবে চিকিৎসক? এখানে কি রোগীর চাপ কম? না, বরং এখানেও রোগীর চাপ রয়েছে। পাশের দেশের রোগীর চাপও অনেক। বিষয়টা হচ্ছে এই চিকিৎসকের হাতে সময় রয়েছে। দুপুর ২টা বা ৩টা বাজলেই নিজের চেম্বার বা বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার তাড়া নেই। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকেও আলাদা করে সময় দিতে হচ্ছে না।
১০ তারিখ রাতে যখন স্ত্রীর গর্ভধারণের ব্যথা উঠলো সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। থাইল্যান্ডকে ইউনিফর্মের দেশও বলা যেতে পারে। যেখানে স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে, সরকারি কর্মকর্তা, বাস চালক, সবারই আলাদা আলাদা পোশাক রয়েছে। আর হাসপাতালেতো সেটি আরও কঠোরভাবে মানা হয়। চিকিৎসক, নার্স, আয়া, ট্রলিম্যান, কর্মচারী, কর্মকর্তা সবার আলাদা আলাদা পোশাক রয়েছে। তাই কে কোন কাজে নিয়োজিত সেটি বুঝতে সমস্যা হয় না।
দেশে অনেককে দেখেছিলাম, গর্ভধারণের রুমের সামনে বসে অপেক্ষা করতে। আমিও সেই প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমাকে ফেরত পাঠালেন কর্তব্যরত নার্স, গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে বললেন, ওকে লেবার রুমে নেওয়া হয়েছে। যখন বাচ্চা হবে, তোমাকে খবর দেওয়া হবে। এখানে বসে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। আমাকেও সহজভাবে মেনে বাসায় ফিরে আসতে হল।
১১ জুন স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে আমার ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ রয়েছেন। আমি আবার তাড়াহুড়ো করে ছুটে চললাম হাসপাতালের দিকে মা ও ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসতে। কিন্তু যেয়ে আবারও হতাশ হতে হলো। ছেলে ও মা’কে দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বাধ্যগতভাবেই অবস্টেট্রিক ওয়ার্ডে থাকতে হবে দুই দিন।
দেশ থেকে যারা ফোন দিচ্ছিলেন, তারা অনেকেই জানতে চাচ্ছিল, কেন দুই দিন থাকতে হবে? আসলে কি সাধারণ নিয়মে প্রসব হয়েছে সন্তান? নাকি সার্জারি প্রয়োজন হয়েছিল? আবার অনেকেই বললেন, দেখো দুই দিন কি বেশি টাকার জন্য রাখছে নাকি হাসপাতাল? আসলে বাংলাদেশের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই ধরনের প্রশ্ন আসে আমাদের। আমারও এসেছিল। অবস্টেট্রিক ওয়ার্ডে শুধু মা ও সন্তানরা থাকে এখানে। আর কোন এটেনডেন্টকে থাকতে দেওয়া হয়নি। কেন? উত্তরে জানা যায়, এতে মা ও সন্তানের বাঁধনটা শক্ত হয়। আর বেশি মানুষ আসলে রোগ জীবাণু প্রবেশের সম্ভাবনাও বাড়ে। আর করোনার মধ্যেতো সেটা আরও বেশি কঠোরভাবে মানা হয়। তাই অগত্যা আরও দুইদিন অপেক্ষা করতে হলো মা ও ছেলেকে দেখতে।
তবে মা ও সন্তানকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ার সময় দেখলাম এই দুইদিন বাধ্যতামূলক থাকার কারণে আমাকে কোন বাড়তি খরচ বহন করতে হয়নি। প্রসবের জন্য যে ৮০ টাকা খরচ করেছিলাম, সেটি সর্বসাকুল্যে খরচ। আর মা ও সন্তানকে বিভিন্ন হাইজিন সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। এরও তিন দিন পরে যখন আবার আমরা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে গেলাম এবার সন্তানের মাকে দেওয়া হলো ৩৪৫ বাথ, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার টাকার সমান। এটা সরকারি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া সকল সন্তানদের দেওয়া হয় প্রাথমিক খরচ হিসেবে।
এছাড়াও যেসব মা ও বাবার আয় বছরে ১ লাখ বাথ বা প্রায় ৩ লাখ টাকার নিচে তাদেরকে প্রতি মাসে দেওয়া হয় ১ হাজার ৮০০ বাথ বা প্রায় ৫ হাজার ৪০০ টাকা। এই ক্যাটাগরিতে আমার স্ত্রী না পড়ায় সে এই অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
১৭ জুন সকাল থেকে স্ত্রী বলছিলেন, তার মনে হচ্ছে ছেলের চেহারা হলুদ হয়ে রয়েছে। আমরা আবারও দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, সেখানে তার বিলুরুবিন পরীক্ষা করা হলো এবং চিকিৎসক জানালেন ভয়ের কারণ নেই। সন্তান সুস্থ আছে। এবং এবার আমি জানতে পারলাম, এই শহরে আগামী ৬ মাস সন্তানকে চিকিৎসা করাতে এবং কোন পরীক্ষা নিরীক্ষাতে আমাদের আর কোন খরচ বহন করতে হবে না।
ট্রাট ছোট শহর। সবাই প্রায় সবাইকে চেনেন। এখানে ডাক্তার যাযারিকপাতি সিনথু’র অধীনে আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে, তার সঙ্গে এক বিকেলে দেখা হলো পার্কে। দৌড়াতে গিয়েছিলেন তিনিও। বললাম, আপনারা রোগীদের অনেক সময় দেন। এই পেশাটাকে আসলেই মহৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন আপনারা। উত্তরে তিনি বললেন, আমি যখন এই পেশায় আসি, তখন আমি সেবা করার জন্য এসেছি। এখানে আলাদা কোন মহত্ব নেই। শিক্ষক, সাংবাদিকের মতো পেশাই এই চিকিৎসা। তবে অতি অর্থের পেছনে দৌড়ালে কোন পেশাই আর মহৎ থাকে না।
ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজকে ২০০২ সালেই গ্রহণ করেছে থাইল্যান্ড। এর কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে, জনগণকে যদি স্বাস্থ্য সুবিধা কম মূল্যে দেওয়া যায়, এতে সরকারেরই ব্যয় কমে। সাধারণ মানুষ যদি স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বহন করতেই জীবন অতিবাহিত করে দেয়, এতে রাষ্ট্রেরই অগ্রগতি থেমে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন বড় সংখ্যক রোগী ভারতের পরই ব্যাংককে আসে চিকিৎসা করাতে। এখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কয়েকগুণ বেশি খরচে চিকিৎসা করান। কিন্তু এই রোগীরা বিদেশে আসছে, তার কারণ কিন্তু স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদেরই বের করতে হবে। আমি শুধু একটি কেস স্টাডি উল্লেখ করেছি।