সামালবং: এক পাহাড়ি গ্রামে

বিবিধ, ফিচার

সম্প্রীতি চক্রবর্তী | 2023-09-01 16:40:44

বাঙালির পাহাড় ভ্রমণের শখ মেটেনা আর আমরা কলকাতার মানুষ পাহাড় বলতে বুঝি রাতটা কোনমতে ট্রেনে কাটিয়ে দিয়ে ভোরের দিকে দার্জিলিং-কালিম্পং। সেবার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'দার্জিলিং' বইটা হাতে পেয়েছিলাম। এবারও ওটি খোঁজার ইচ্ছা ছিল, তবে কিভাবে জানি না হাতে এসে গেলো পরিমল ভট্টাচার্য্য এর লেখা 'দার্জিলিং'।

বইটি কিছুটা গোগ্রাসে গিলে বোঝা গেলো, এই লেখা পড়ে আর যাই হোক টুরিস্ট হিসেবে পাহাড়ে যাওয়া যায় না। বইটির আদ্যপান্ত জুড়ে পাহাড়ি মানুষ, তাদের জীবনশৈলী নিয়ে কথা; একবার একটি পাহাড়ি ছেলে লেখককে নিয়ে গেছিলেন তার নিজের গ্রামে, সেখানে আধুনিক সভ্যতা বলতে নাকি কেবল প্লাস্টিকের দ্রব্য পৌঁছেছে, মানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জলের জোগান বা পরিমিত বিদ্যুৎ, এ সবের আগে যেটা তারা হাতে পেলো, তা রং বেরং-এর প্লাস্টিকের পাত্র, বাটি, গেলাস।

ছেলেটির সঙ্গে লেখকের সেভাবে আর পরে যোগাযোগ হয়নি, তবে উনি জানতে পারেন পুনেতে একটি ওষুধের কোম্পানিতে ছেলেটি কর্মরত, পাহাড় থেকে অনেক দূরে, কাজের চাহিদায় সে সমতলের মানুষ হয়ে উঠেছে, অন্তত হওয়ার চেষ্টা করেছে হয়তো।

বই-এর কিছুটা পড়ে আর সময় দেওয়া গেলো না, কারণ এবার রওনা দিতে হবে। মনে মনে ছবি আঁকছি পাহাড়ের আর সাথে ভাবছি এই আমাদের মতো হামলে পরা টুরিস্টদের কথা। মাঝরাতে জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম, চারটে বাজতে না বাজতেই পাহাড়ের রাস্তা ধরা হলো। বিভীষিকা কাকে বলে! অন্ধকার পথ, বিশাল চাঁদ আর গাড়িটা সটাং উঠে যাচ্ছে ঢালে আবার কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই হুস করে নামছে। আলো থাকলে তাও সামনেটুকু দেখা যেত। তবে এই ভীষণ ওঠা-পরার মধ্যেও যেটা একমাত্র পাওনা, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর পূর্ণিমার চাঁদ, যা পাহাড়ের বাকে বাকে হঠাৎ দেখা দিয়ে অদৃশ্য হচ্ছে আর কি ভীষণ নীল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। রাতের পাহাড় একদিকে যেমন বীভৎস আবার খুব আত্মবিশ্বাসী। প্রচুর উঁচুনিচুর মধ্যেও কেমন যেন জেদ চেপে যায়, রাস্তা শেষ হবেই, গন্তব্য আসবে, সে যতই চড়াই-উৎরাই থাকুক না কেনো।

দার্জিলিং কয়েকদিন কাটিয়ে আমরা গেলাম ছোট পাহাড়ি গ্রাম সামালবং-এ। কালিম্পং পৌঁছে ঘণ্টা দুই আরও লাগে গাড়িতে। যেহেতু একটু রিমোট এরিয়া তাই গাড়িতে আমরা বাদে আর সকলেই গ্রামের বাসিন্দা। পাহাড়ের সরু রাস্তা বেয়ে গাড়ি গিয়ে থামলো একেবারে নির্জন স্থানে। হোটেল বলতে একটাই, আর আশেপাশে দুটো দোকান, ব্যস।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে আমরা বেরোলাম একটু হাঁটতে। ক্রমশ সন্ধ্যে হয়ে আসছে, টর্চের আলোয় খুব বেশি দূর দেখা যায় না। নির্জন সন্ধ্যাবেলা, পাহাড়ি চুড়ো, শনশনে হাওয়ায় আমরা দু কাপ চা নিয়ে বসলাম। সময়ের অস্তিত্ব বোঝা কঠিন এখানে, আকাশের একফালি চাঁদ আর অনেক নিচে একটা নদী বয়ে যাওয়ার হালকা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। দোকানি একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিলেন, সেটা নিয়ে পাহাড়ের ধারে বসার রীতি আছে। বিশেষ কিছু দৃশ্য উপভোগ করছি তা নয়, তবে রাতের পাহাড়, তার সমস্ত রহস্য নিয়ে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি।

দোকানি গল্প জুড়লেন, গ্রামের প্রচুর জমির মালিক উনি নিজেই। আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, এখন voluntary retirement নিয়ে গ্রামেই থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে দোকান দেখাশোনা ও চাষবাস করেন। বাংলা, হিন্দি দুটোতেই সড়গড়, বললেন আরও অনেক ভাষা জানেন, ভাষা শেখা ওনার অন্যতম শখ। এই গ্রামেই জন্ম, বড় হওয়া, এখান থেকে মূল শহর প্রায় দুঘণ্টার পথ। আশেপাশের জমিতে ধানচাষ হয়, বর্ষাকালে ভাতের জোগানে অসুবিধা হয় না, তবে বাকি রসদে টান পড়ে। ভীষণ বৃষ্টিতে মূল শহর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কিছুদিনের জন্য, এটাই সমস্যা।

এরপর এক এক করে ছেলেবেলার গল্প, গ্রামের ইতিহাস, মানুষজন আসতে লাগলো কথাবার্তায়। তিরিশ, চল্লিশ বছর আগেকার সামালবং, পাহাড় ডিঙিয়ে যাতায়াত করতেন ওনারা জোয়ান বয়সে, পায়ে হেঁটে, নদী পেরিয়ে। এখনকার ছেলেমেয়েরা যদিও স্কুটি বা সাইকেল ব্যবহার করে।

পাহাড়ের ধারে বসে গল্প করছি, ইতিমধ্যে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। অদূরে সোনালী রঙের আলো, পাহাড়ের গায়ে, ভাঁজে ভাঁজে। আলোর দিকে তাক করে বললেন ওগুলো দাবানল। সারা রাত হয়তো জ্বলবে, গ্রামের লোকালয় গুলোতে গাছপালা কেটে দেওয়া হয় যাতে নিশুতি রাতে আগুন হানা না দিতে পারে। ধিকিধিকি আগুনের পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আমরা যেখানে বসে আছি।

এর মধ্যেই বৃষ্টি নামলো। তাড়াতাড়ি ছুটলাম হোটেলের দিকে। ঘরের বিছানায় বসে বৃষ্টি দেখছি নীল পাহাড়ে, চা আর মোমো আছে সাথে। বিদ্যুৎ না থাকায় বেয়ারা এসে মোমবাতি দিয়ে গেলো। কেমন যেন নীল আভা চারিদিকে, বুঝলাম পাহাড়ে বৃষ্টির আওয়াজ অন্যরকম। কেমন সময়ের চাকা থেমে যায়। চা, বৃষ্টি, পাহাড়, প্রথম দিনটা একবারে মন মতো কাটলো। ইতিমধ্যে হোটেলের দুই পোষ্য আমাদের ঘরের সামনে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রাত প্রায় হয়ে এলো, আগুন নিভলো কিনা ভাবছি।

পরেরদিন সকালবেলা উঠে জায়গাটা ঘুরে দেখাই একমাত্র কাজ। কালিম্পং জেলার এই গ্রামটি এতটাই প্রত্যন্ত যে খুবই স্বল্প মানুষ বসবাস করেন এখানে। আমরা হেঁটে পাহাড়ের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম, একেবারে ধারে যেতে ভয় করে, যেন পৃথিবীর শেষ সীমানা, ভয়ঙ্কর সুন্দর, কাছে যেতে মন চায় আবার পরক্ষণেই পা হরকানোর ভয় চেপে ধরে।

সামালবং এর এই view point এ দাঁড়িয়ে কালিম্পং শহরটাকে পুরো দেখা যায়। পাশেই চায়ের দোকান, আমাদের বয়সী এক দম্পতি ও তার ছোট মেয়ে রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া দোকানে, পাশেই তাদের বাড়ি ও খামার। লাল চা নেওয়া হলো, অসম্ভব ভালো খেতে, অজানা কোনো মশলা দিয়েছে নিশ্চয়ই, কি ভীষণ সুবাস তার। তিন কাপ পরপর চললো, সাথে অমলেট। ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তায় জানা গেলো তাদের দোকানটি গ্রামের সদাই হিসেবে পরিচালিত হয়। টুরিস্ট-এর রমরমা নেই বলে গ্রামের লোকেরাই বিকেল করে আসেন দোকানে, চা খায়, আড্ডা দেয়। দূর থেকে দেখেছি সেই পাহাড়ি আড্ডা। শাল গায়ে দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কের দল টিমটিমে আলোয় বসে আছে। হাসি ঠাট্টা মস্করা চলছে তাদের নিজস্ব ভাষায়।

পরের দিন আবার গেলাম সেই ভিউ পয়েন্টে। দোকানি দম্পতি জানালেন তারা মশলা, রান্নার সামগ্রী বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করেন। ওটাই তাদের আয়ের মূল উৎস। তাদের ছোট মেয়েটিকে আগের দিন দেখেছিলাম। সে সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, মা তাকে রোজ সকালে পৌঁছে দেন পাহাড়ি পথ হেঁটে। আর বাবা সকাল থেকে মুরগি, সবজি কেটে, বাসন ধুইয়ে দোকান খোলায় ব্যস্ত থাকেন। আমরা চা খাচ্ছি, মহিলা ইতিমধ্যে চলে এসেছেন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে। গল্প করতে করতেই দেখলাম ভদ্রলোক বাসন ধুতে প্রায় পাহাড়ের খাদ বরাবর নামছে। কেন বুঝলাম না, মনে হলো আরে, একটু ওপরেও তো কাজটি করা যায়!
জিজ্ঞেস করলাম ভয় লাগে না আপনাদের এইভাবে নেমে যেতে? তার স্ত্রী বললেন, অনেকবার পড়ে গেছে, একেবারে নিচে গড়ানোর অবকাশ নেই, আবার পাহাড় বেয়ে উঠে আসতে পারবে, অসুবিধা নেই। মানে আমাদের কার্নিশ থেকে বল তোলবার মতো ব্যাপার, ভারী অদ্ভুত বিষয়।

কথা হচ্ছিলো গ্রামে জল সরবরাহ নিয়ে, আগে অনেক দূর থেকে জল বয়ে আনতে হতো, এখন দূরের ড্রাম থেকে পাইপ দিয়ে এক একটা স্থানে জল পৌঁছে যায়, কিন্তু প্রত্যেক বাড়ির আলাদা সময় বাঁধাধরা আছে। দোকানি দম্পতির রাতের বেলা স্লট, তাই অনেক ভোরে উঠতে হলেও রাতে জলের জন্য কিছুটা সময় দিতেই হয়।

পারিবারিক বিষয়ও কথা হচ্ছিল। ছেলেটির বাড়ি সিকিমে, আগে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজ করতেন, আপাতত সামালবং, তার শ্বশুরবাড়ি, সেই দোকানেই কাজ করেন স্ত্রী কন্যার সাথে। কথায় কথায় আমাদের ফোন নম্বর নিলেন, কখনো কলকাতায় আসলে যোগাযোগ করতে বললাম। বাচ্চা মেয়েটি খুব হাসিখুশি, কোনো জড়তা নেই, আমাদের দেখে লজ্জা না পেয়ে নিজের মনে খেলা করে।

সামালবং খুব ভালো লাগলো, নির্জন গ্রাম, সকলে মন খুলে কথা বলে, পাহাড়ে বেঁচে থাকার গল্প, জল, খাবার জোগান, নিজেদের খামারে মুরগি, ছাগল পুষে কিভাবে জীবন চলে তাদের। আমরা বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক পরিত্যক্ত বাড়িতে, মনে হলো কোনোদিন হয়তো স্কুল ছিলো, এখন কোনো কারণে বন্ধ, পাহাড়ের চূড়ায় বেঞ্চি পাতা, তাতে বসে গল্প করছি, সারা শহরটা দেখা যাচ্ছে নিচে। সামনের রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর গ্রামের লোক হেঁটে যাচ্ছে, দু একটা গাড়িও চলছে। এক মহিলা তার ছোট মেয়েকে কাঁধে নিয়ে আসছেন, পাহাড়ি বাঁকে কোনো জড়তা নেই তাদের। মহিলা তার মেয়েকে ইংলিশ অ্যালফাবেট শেখাচ্ছেন, একটা করে পা ফেলা আর B for বলে থেমে গেলে মেয়ে উত্তর দেয় Bat.

সন্ধ্যে হয়ে আসছে, এবার হোটেলের পথে ফিরবো, ভাবছি কাল এই সময় শহরে ঢুকে গেছি। এমন শান্তির বিকেল কতদিন কাটাইনি, হালকা ঠান্ডা, শনশনে হাওয়া, আর পাহাড়ের স্তব্ধতায় একঘেয়ে লাগলে গ্রামবাসীদের সাথে দু-চার কথা বলে নেওয়ার মুগ্ধতা, আজীবনের মহার্ঘ্য সঞ্চয়।

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, ইতিহাস বিষয়ক গবেষক, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর