ওয়াহেদুল করিম বাবুল: জীবন-উদযাপন করা আমার বাবা

, ফিচার

সেমন্তী ওয়াহেদ | 2023-09-01 13:36:17

আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি, আমার একজন সহপাঠী ওর বাবার হাতে প্রতিনিয়ত নিজের ও ওর মায়ের নির্যাতনের ঘটনার কথা উল্লেখ করে ভীষণ কেঁদেছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই দিনের পর, আমি, ঈশ্বর/আল্লাহ/ভগবান/প্রকৃতি, আমরা যে যেই শক্তিতেই বিশ্বাস করিনা কেন- আমি সেই পরম শক্তির কাছে কখনও নিজের জন্য কিছু চাইনি। সেই মুহূর্তে এগারো আর বারোর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা আমি দিব্যি উপলব্ধি করেছিলাম যে মানবিক গুণসম্পন্ন বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠা সকলের জীবনে নাও হয়ে উঠতে পারে, সে নিশ্চয়তা হয়তো অনেকের জীবনকে এঁড়িয়েই চলে যায়; জীবনের বাঁক আঁধারে নিমজ্জিত করে। আমার মত যে সব সন্তানের প্রয়াত বাবার স্মৃতিচিহ্ন মিশে আছে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, প্রতি নিঃশ্বাসে, থমকে না যাওয়ার প্রতি বিশ্বাসে; সেই বাবার কথা লিখতে গিয়ে অক্ষর মিশে যায়-ভেসে যায়, অশ্রুভেলায়।

ছোটবেলায় বাবাই প্রথম বলেছিলো," শোন, তোকে যদি কেউ বলে তুই নিনি আর বাবুলের একমাত্র মেয়ে, সুন্দর করে বলবি, না, আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান"। আট বছরের আমি তোতা পাখির মত প্রায়ই অগ্রজদের এই ভুল শুধরে দিতাম। বাবা মুচকি মুচকি হাসতো। আর বেড়ে উঠতে উঠতে সেই আমি অনুধাবন করেছি কত সহজেই পুত্র কিংবা কন্যা সন্তানের সামাজিক কাঠামোতে আবদ্ধ না করে বাবা আমাকে শুধুই মানুষ, এক মুক্ত-স্বাধীন সত্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ছিল সহায়ক শক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ত্রে কিংবা বোভোয়ার একাধিকবার পাঠ করে যে দর্শনের নির্যাস আন্দোলিত করেছে মন, সেই মানসপট বহু আগেই নির্মাণ করেছিল বাবা।

বাবা-মায়ের সঙ্গে সেমন্তী ওয়াহেদ

আমাদের বাসায় বাবার কিছু পরিচিতজন এসেছিলেন একদিন। তাঁদের কথপোকথনের এক পর্যায়ে বাবা বেশ সহজ ভাষায় তবে কঠিন কণ্ঠে বলেছিল, "কি বললে? নিনিকে আমি স্বাধীনতা দিয়েছি? নিনিতো পরাধীন নয় তাই ওকে স্বাধীনতা দেবার প্ৰশ্নই ওঠে না। আমি যেমন, ঠিক নিনিও তেমন, দুজনেই সমান ও স্বাধীন"। নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকার বাবার উচ্চারণের মতন স্পষ্ট করে যেন ধারণ, লালন ও পালন করে বিশ্ব। 

কৈশোরপ্রাপ্তি থেকে কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সী মেয়েদের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসা আমাদের উপমহাদেশের গন্ডি পেরিয়ে অভিবাসী বাঙালি সমাজের জন্যও সমান প্রযোজ্য। মানুষ সামাজিক জীব এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সামাজিকতার সেই অংশ যা নিজের ইচ্ছায় চাইলে বেছে নিতে পারি, কোন পারিবারিক বা সামাজিক বাধ্যবাধকতা ছাড়া, এই পরিচ্ছন্ন দৃ‌ষ্টিভঙ্গি যতটা মায়ের তার চাইতেও বেশি, বোধহয়, বাবাই প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে, "বিয়ে করতেই হবে কেন?" কেউ যদি জানতে চাইতো, "বাবুল ভাই, সেমন্তীর বিয়ে দেবেন না?" অথবা " মেয়ের বিয়ে হয়নি?" সেই সময়ে প্রতিবার বাবাকে বলতে শুনেছি, "আমাদের পরিবারে মেয়েদের বিয়ে দেই না, হয়ও না, আমাদের পরিবারে মেয়েরা বিয়ে করে, তাও চাইলে"। কন্যার বিয়ে দেওয়া, হওয়া ও করা নিয়ে বাবার যেই উক্তি শুনে বেড়ে উঠেছি তা আমি আজও বলি। আজ তা বোধ করি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। 

শিক্ষা ও জ্ঞান নিয়ে যেই কথাটি আমি হরহামেশা আমার "ছাও-পাও" অর্থাৎ আমারই প্রজন্মের তবে আমার চাইতে বয়সে ছোট এই মাটিতে জন্ম কিংবা বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে বলে থাকি, তা বাবার বোঝানো আরও একটি কথা। "আপনার এত মেধাবী মেয়ে কেন বিজ্ঞান, আইন বা অর্থনীতি, এই ধরণের কোন বিষয় নিয়ে পড়লো না? ওতো অনায়াসে কোন আইভি লীগে পড়তে পারতো?" এই সব প্রশ্নের উত্তরে বাবার বরাবর ঠোঁটের ভাজে হাসি মাখানো অভিব্যক্তি জ্বলজ্বল করে ভাসে। আমার পড়াশোনা প্রসঙ্গে বাবা-মা কখনও জোর করেনি; না বিষয় নিয়ে, না বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। শুধু একটি অনুরোধ করেছিল বাবা, আমার শিক্ষা যেন জ্ঞানে পরিণত হয়, তাতে যেন মানুষের কল্যাণ হয়, শুধু চারকোণে একটি তকমা-সম্পন্ন কাগজে সীমাবদ্ধ না রয়ে যায়। 

বাবা জীবনযাপনে নয়, জীবন-উদযাপনে ছিল দৃঢ় বিশ্বাসী আর তাই বাবা জীবন উদযাপন করেছে দুটি অধ্যায়ে। প্রথম অধ্যায় যেমন জ্ঞান ও অর্থে প্রাচুর্যপূর্ণ দ্বিতীয় অধ্যায় তেমনি বিকশিত বোধ ও রুচিশীলতায় পরিপূর্ণ। সাতচল্লিশে বাবারা সপরিবারে নদিয়া শান্তিপুর থেকে বসতি গড়ে ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বাবার জীবন যেন এক বাস্তব রূপকথা। বাবা ভীষণ মেধাবী ছিল, ওর ছিল তুখোড় স্মরণশক্তি। ক্রিকেটের মাঠে তখন বাবার অল রাউন্ডার হিসেবে ছিল খ্যাতি। মন চাইলেই বাবা উড়োজাহাজে চড়ে শারজার মাঠে ক্রিকেট খেলা উপভোগ করতে যেত। বাবার সাদা ড্যাটসান সাজিয়ে সেই সময়ে গেন্ডারিয়ায় বিয়ে হয়নি বোধহয় এমন কেউ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার ৪৯ দিনোনাথ সেন রোডের সুবিশাল বাড়ি ছিল আশ্রয় স্থল। আমার মায়ের সাথে এক দশক প্রণয়ের সময়ে কলকাতার মঞ্চে উৎপল দত্ত, সম্ভু ও তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় দুজনে দেখতে গেছে বহুবার; লরেন্স অলিভিয়ার ও গ্রেগরী পেক থেকে দিলীপ কুমার ও মধুবালা কিংবা উত্তম-সুচিত্রার প্রতিটি সিনেমা বাবার বারবার দেখা। বাবা নিমগ্ন হয়ে সব ধরনের গান শুনতো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দি সিনামার গান শুনতে বাবা বেশি ভালোবাসতো। মোহাম্মদ রফির কণ্ঠ বাবার কাছে ছিল বিশেষ প্রিয়।

সেই সময়ের উচ্চশিক্ষিত, ধনাঢ্য বনেদি-জমিদার পরিবারের সুদর্শন এক পুত্রের অকল্পনীয় জীবন বাস্তবে অতিবাহিত করা আমার বাবা সেই বর্ণাঢ্য জীবন সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে নব্বই সালে হঠাৎই পারি জমিয়েছিল নিউইয়র্ক নগরীতে। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ৩৬ এভিনিউর যেই ওয়াশিংটন টাওয়ারে বাবা প্রথম এসে উঠেছিল, সেই বিল্ডিং-এই বাবা থেকেছে আমৃত্যু। নিজের সাদা ড্যাটসান নয়, টি এল সির হলুদ গাড়ি গর্বভরে চালিয়েছে বাবা; কাজ করেছে রেস্তোরাঁয়। গাড়ি চালানো, বিল্ডিং সিকিউরিটি অথবা দোকান বা রেস্তোরাঁয়ে কাজ করাকে অনেকেই আখ্যায়িত করে "odd job" হিসেবে আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা আইনজীবীদের কর্মকে বলা হয়ে থাকে "career"। কোনো প্রকার সৎ উপার্জন "odd" অর্থাৎ উদ্ভট বা অস্বাভাবিক নয়, শুধুই চাকরি, কাজ বা "job" এবং এই ধরণের শ্রেণী বৈষম্য দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজের শিক্ষিত মানুষেরাই করে থাকে এবং এর ফলে শুধু শ্রেণী বৈষম্যই বৃদ্ধি পায় না, ব্যক্তি মনে বাসা বাঁধে হীনমন্যতা- মনস্তাত্ত্বিক এমন অনেক বিশ্লেষণ শুনেছি বাবার মুখে। 

আমাদের সামাজিকতায় আমরা সাধারণত বয়সে ছোটদেরকে বেয়াদব বা বেত্তমিজ বলে থাকি। আমার ছোটবেলায়, বাবা, একজনের আচরণের প্রেক্ষিতে বুঝিয়েছিল, "মা, অনেক সময় বয়সে বড়রাও এই শব্দ দুটির আভিধানিক অর্থের মত আচরণ করে থাকে, অনেক সময় বয়সের সঙ্গে রুচির মিল তুই নাও খুঁজে পেতে পারিস, তবে নিরাশ হবি না"। জীবনে কথার মূল্য আছে, বিশেষ করে এক একটি শব্দের অর্থের- তা যেমন মা শিখিয়েছে, সেই শব্দের মূল্যায়ন ও প্রাত্যহিক ব্যবহার প্রতি মুহূর্তে শিখিয়েছে বাবা। 

বাবা সাহিত্যিক, গবেষক, বা বুদ্ধিজীবী ছিল না। মানসম্পন্ন লেখক, সুবক্তা, গুণী বিশ্লেষক বা পন্ডিত চিন্তাবিদ হবার জন্য যে চর্চা ও অধ্যবসায় প্রয়োজন বাবা কখনোই তা করেনি। নামের আগে একাধিক বিশেষণের ভার বহন করে বাবার ওজন কখনো বাড়েনি। কোন আসন কিংবা সম্ভাষণে মুখ্য বা প্রধান হিসেবে বাবাকে দেখা বা নাম শোনা যায়নি। বাবা সবসময়ই নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। অতি সহজ-সরল, সাদা-মাটা, সাধারণ আমার বাবা ওর মতো করে জীবন পরখ করেছে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবা ওর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন উদযাপন করেছে। আমার ৩৫ বছরের জীবনে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষার চাইতে পৈতৃক সম্পদ হিসেবে পাওয়া বাবার দৈনন্দিন জীবন উদযাপনের জ্ঞান আমার কাছে অমূল্য, অসামান্য- আমার বাকি জীবন অতিবাহিত করবার পাথেয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর