রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসনে জাতীয় ও বৈশ্বিক দায়িত্ব

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 04:38:32

মিয়ানমান থেকে পাঁচ বছর ধরে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে যাদেরকে মানবিক সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সীমান্তে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ফলে রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে সমস্যার শেকড় বাড়ছে। মানবিক সমস্যাটি ক্রমেই নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পরিণত হচ্ছে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাতের জেরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে প্রায়ই নিরাপত্তার ঝুঁকি ও অস্থিতিশীলতার উদ্ভব ঘটছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে বেশ কয়েকদিন আগে গোলাগুলি শুরু হয়। এক পর্যায়ে একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে। এতে এক রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যু হয়।

ওই ঘটনায় এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা নাগরিক আহত হন। এর আগে ও পরে কয়েক দফায় মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের ভেতরে। প্রতিবারই মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। এছাড়াও রোহিঙ্গা সমস্যার নানাদিক নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসিয়ান জোটের দূতদের ব্রিফিং করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও উদ্যোগী ভূমিকার আহ্বান জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক সাহায্য প্রদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও সমস্যাটি এককভাবে বাংলাদেশের নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার অংশ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর এই স্পর্শকাতর অবস্থানকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাগত ঝুঁকি ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হলে তা আঞ্চলিক শান্তি ও আন্তর্জাতিক ভারসাম্যকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা পালনের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি অগ্রাধিকারের অংশ।

এক্ষেত্রে কতিপয় বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে সমস্যার সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া জরুরি।

১. রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের মানবিক ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক ও কার্যকরী, যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতায় অব্যাহত রাখা আবশ্যক। ফলে সরকারের আহ্বানে বিশ্ব সম্প্রদায়কে ইতিবাচক মনোভাবে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

২. রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির কারণে মিয়ানমানকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও চাপ সৃষ্টি করে তার দেশের নাগরিকদের প্রত্যাবাসন ও সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে নিয়ে যাওয়ার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা ও দেশকে এক্ষেত্রে আন্তরিকতার মাধ্যমে একযোগে কাজ করতে হবে।

৩. মিয়ানমান কর্তৃক সীমান্তে অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্ভাব্য মানবিক ও নিরাপত্তা বিপর্যয় রোধে জরুরি ভিত্তিতে তৎপর হতে হবে। শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপচেষ্টা থেকে মিয়ানমানকে প্রবল চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নিবৃত্ত করতে হবে।

৪. বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে। পাঁচ বছরে এই সমস্যা থেকে আরও যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং সম্ভাব্য আরও কি কি সমস্যা হতে পারে, সে সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে হবে। যার ভিত্তিতে দেশীয় ও বিদেশি নীতিনির্ধারকগণ যথাযুক্ত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারবে।

৫. রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রভূত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা, তা মনিটর করতে হবে এবং এক্ষেত্রে কার্যরত এনজিও ও তার লোকবলকে পরিবীক্ষণে রাখতে হবে। এনজিওগুলোর তরফে দাতাদের মানবিক সমস্যাসমূহের পাশাপাশি নিরাপত্তাসহ অন্যবিধ সমস্যাগুলো সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করতে হবে।

৬. রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ও স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সংঘাত ও উত্তেজনা নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে।

৭. রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতির আলোকে জনমত গঠনের দিকে মনোযোগী হতে হবে।

৮. আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশগুলোকে সমস্যার বহুমাত্রিক বিপদগুলো সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ ও ব্রিফিং দিয়ে তাদেরকে আরও সরব ও তৎপর করতে হবে।

৯. রোহিঙ্গা ক্যাম্প, আশেপাশে এলাকা, বিশেষত পার্শ্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমুদ্রপথের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে এবং সেখানে সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, মাদক ও মানব পাচারের মাধ্যমে নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টিকারী তৎপরতার মূলোৎপাটনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

১০. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রান্তিক এলাকা কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনে জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ও কৌশলে এসব বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসনে জাতীয় ও বৈশ্বিক দায়িত্ব রয়েছে। সমস্যাটি বাংলাদেশের উপর আপতিত হলেও এর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্য অপরিসীম। ফলে এ সমস্যার ব্যাপারে বাংলাদেশ যেমন মানবিক দায়িত্ব পালন করছে, বিশ্ব সম্প্রদায়ও এগিয়ে এসেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে যেভাবে নিরাপত্তা ও অন্যবিধ সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে, তা সকলের জন্যেই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ফলে এসব সমস্যার আশু ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে সবাইকে তৎপর হওয়ার বিষয়টি বর্তমানে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর