মুক্তিযুদ্ধের গান : আমাদের সাংস্কৃতিক বিপ্লব

বিবিধ, ফিচার

রায়হান রহমান রাহিম, কন্ট্রিবিউটর | 2023-09-01 17:22:37

“মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলি দান
লেখা আছে অশ্রু জলে”

পরাধীনতা শেঁকল ভেঙে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালি জাতির পূর্ণাঙ্গ আত্মপ্রকাশ ঘটে। জাতি হিসেবে কাগজে কলমে স্বাধীনতার এই স্বীকৃতির সমস্ত ইতিহাস খুঁজলে আজও শুধু রক্তগঙ্গার উত্তাল ঢেউ প্রিয়জন হারিয়ে চিরস্থায়ী শূন্যতার খতিয়ানে তীব্র যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত আমাদের বারবার শুধু স্তব্ধই করে দিয়ে যায়। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যাওয়া সমস্ত সূর্য-সন্তানদের এই মহান আত্মত্যাগের পাশাপাশি বাঙালি জাতির একটা বিরাট সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কালও কিন্তু ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নানা সাংস্কৃতিক চিন্তা, কর্মকাণ্ডের ইতিহাসের দিকে গভীর মনোনিবেশ করলে একটা বিষয় সেখানে খুব স্পষ্ট চোখে পড়ে। সেটি হলো যুদ্ধ চলাকালীন জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যের বুনিয়াদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসা ওই গানগুলোই গড়ে দিয়েছিল। উত্তাল সেই দিনগুলোতে প্রিয়জন হারানোর বিভৎস কষ্টে ভেঙে না পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবমান প্রত্যেকটি সত্তার কাছে এই গানগুলো এসে এমনভাবে মিশেছিল যেন একেকটা গানই শুধু হতে পারে সম্মুখ সমরে লড়াই চালিয়ে যাবার একমাত্র শক্তি। বিজয়ের এই দিনে রক্ত সংগ্রামে মাখা সেই শক্তিমান গানগুলোকে নিয়ে রইল আজকের পাঠকদের জন্য বিশেষ আয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গান, তার মনস্তত্ত্ব এবং ইতিহাস সমন্ধে ভালোভাবে জানতে হলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। কারণ দেশ ও জনতাকে স্বাধীনতাকামী এবং অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলার প্রয়াসে গান রচনার ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের তখন দুইটি অংশ ছিল। একটি পূর্ব পাকিস্তান আরেকটি পশ্চিম পাকিস্তান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানই বর্তমান বাংলাদেশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত। পাকিস্তানের এই দুই অংশের প্রথম বিবাদ শুরু হয়েছিল মাতৃভাষার প্রশ্নে। অন্যায়ভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নে আপোসহীন বাঙালি জনতার ওপর ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার গুলিবর্ষণ করে। সালাম, বরকত, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকেই গুলির আঘাতে শহিদ হন। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দানের ঘটনা সারা পৃথিবীতে এটিই ছিল প্রথম। এবং সে ঘটনার পরপরই চাপের মুখে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বলা যায়, জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রথম প্রচেষ্টাটিই ছিল মাতৃভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে এই প্রাণদানের সংগ্রামী ইতিহাস।

তৎকালীন ২১ শে ফেব্রুয়ারির সেই মর্মান্তিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বাগেরহাটের চারণ কবি শামসুদ্দিন আহমেদ একটি গান রচনা করেছিলেন—

“রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও
করিলিরে বাঙালি
তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি”

প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে লোকসুর আরোপ করে গাইতেন। পরবর্তীতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ গানে নতুন করে সুরারোপিত করেন এবং রথীন্দ্রনাথ রায়ের কন্ঠে গানটি বিখ্যাত হয়।

সে সময়েই ফজল এ খোদা রচনা করেছিলেন আরেকটি গান—

“সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাঁদের স্মৃতির চরণে
মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান
তাদের বিজয় মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাঁদের স্মৃতির চরণে”

আব্দুল জব্বার সুরে এই গান আব্দুল জব্বারের কণ্ঠেই দেশ জুড়ে প্রবল সমাদৃত হয়।

একুশের যে গানটি আমাদের জাতীয় চেতনার সাথে মিশে আছে সে গানটি রচনা করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ওইদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ শহিদ রফিকের লাশ দেখে ফেরার পর তিনি লেখেন—

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু
ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”

প্রাথমিকভাবে গানটিতে আবদুল লতিফ সুরারোপিত করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

একুশে ফেব্রুয়ারির আরেকটি গান বেশ বিখ্যাত। আবদুল লতিফের সে গানটি হলো—

“ওরা আমার মুখের ভাষা
কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায়”

আবদুল লতিফ নিজেই এই গানটিতে সুর দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত জনতার ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা এই দেশের মানুষকে হতবাক করে দেয়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পর দেশের প্রায় সব জায়গায় আপামর জনতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের সেই যুদ্ধে লক্ষ প্রাণের ঝরে যাবার মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম।

যুদ্ধকালীন আঘাত-পাল্টা আঘাতের পাশাপাশি মননশীলতার যে সংগ্রাম, সেটিও যুদ্ধকে দারুণভাবে গতিশীল করেছিল ৷ ২৫ শে মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-পরবর্তী ২৮ শে মার্চ যত্রতত্র বিমান হামলায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশমালা চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে ৩০ শে মার্চ বেতারে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি বাজানোর মধ্য দিয়েই ধারণা করা যায় মুক্তিযুদ্ধে দেশের গানের ভূমিকা ইতিহাসের সূচনা।

ওইদিন বেতার কেন্দ্রে পাক বাহিনীর বিমান হামলায় কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপরই প্রতিষ্ঠাতাগণ দুটি দলে ভাগ হয়ে কিছু অক্ষত বেতার যন্ত্রসহ আগরতলা ও শিলিগুড়ি সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। এবং সেখান থেকেই দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই মহৎপ্রাণ মানুষেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেতারে সম্প্রচার করতেন। ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন-পরবর্তী সরকার ও বেতার কর্মীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার তাদের একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার প্রদান করেছিলেন। তার পরপরই সমস্ত বেতার কর্মীরা ধীরে ধীরে মুজিবনগরে এসে জড়ো হতে থাকেন এবং কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়ি থেকে পুনরায় নতুন করে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়, যার নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রই ছিল পুরো মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এখানে বসেই গান লিখে, তৎক্ষণাৎ সুর প্রদান করে গেয়ে গেয়ে প্রচার ছিল যুদ্ধের ভেতর আরেক যুদ্ধের মতো কঠিন কাজ। তবে প্রাথমিক অবস্থায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো নিজস্ব গান ছিল না। ডিএল রায়, রবিঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানগুলোর সাথে গণনাট্য সংঘের গানগুলো প্রচার করা হতো, প্রচার করা হতো একুশে ফেব্রুয়ারির সময়কার গানগুলোও। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে মুক্তিকামী মেধাবী গীতিকার, সুরকার, গায়কেরা স্বেচ্ছায় এসে যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ধীরে ধীরে তাদের কাছ থেকে একের পর এক কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান উঠে আসতে থাকে যা মুক্তি সংগ্রামের লড়াইকে অভূতপূর্ব গতিময়তা প্রদান করেছিল।

সে সময় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল যাদের নাম না বললেই নয়। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের ওই সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গান শোনাতে যেতেন। তারা ট্রাকে করে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে দেশের গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বু্দ্ধ করতেন। জানা যায়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত পরিচালক সমর দাসের ডাকে সারা দিয়ে তারা বেতারেও গান পরিবেশন করেছিলেন। তাদের এই সংগ্রাম মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, আলোকচিত্র শিল্পী লিয়ার লেভিন ফুটেজ আকারে ধারণ করে দেশে ফিরে গেলে পরবর্তীতে সে ফুটেজ থেকেই তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন বিখ্যাত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’৷

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যেসব বিখ্যাত গান তৈরি হয়ে পরবর্তীতে প্রচারিত হয়েছিল সেগুলোই ছিল মুক্তিযোদ্ধা এবং আপামর দেশবাসীর কাছে লড়াইয়ের সাংস্কৃতিক রসদ। সেসব বিখ্যাত গানগুলো সমন্ধে এবার একটু জেনে আসা যাক।

“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি”

গোবিন্দ হালদারের লেখা আপেল মাহমুদের সুর এবং কণ্ঠের এই গান শুনলেই বোঝা যায় ঠিক কোন পরিস্থিতিতে পড়ে বাঙালি জাতি যুদ্ধে নেমেছিল।

চিরকালীন শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে আচমকা যুদ্ধের ইতি বাঙালি বিজয় দিয়েই দেখতে চেয়েছিল যাতে এসে সামিল হয়েছিল অসংখ্য দেশপ্রেমী মানুষের মহান দেশপ্রেমের অনুভব আর প্রাণপণ লড়ে যাবার গৌরবদীপ্ত বাসনা। সে সময় নঈম গহর লিখেছিলেন—

“নোঙ্গর তোলো তোলো
সময় যে হলো হলো
নোঙ্গর তোলো তোলো”

পরবর্তীতে সমর দাস তাতে সুরারোপিত করলে বাঙালি যেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে নতুন করে মনে বল অনুভব করে।

গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘মাগো ভাবনা কেন’ গানটি শুনতে শুনতে কত তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যে ঘর ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল ইতিহাসে আজ সেসব হিসেব নেই।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষদের মাঝে সংখ্যায় একটা বিরাট অংশ যারা ছিলেন বয়সে তরুণ। তরুণদের বাঁধনভাঙা রক্ত টগবগ করা সাহস স্বাধীনতার সংগ্রামকে দিয়েছিল একটা নতুন মাত্রা। সেইসব তরুণ প্রাণকে উদ্দীপনা প্রদান করতে সে সময়ে রচিত হয়েছে প্রচুর গান। তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান হচ্ছে গোবিন্দ হালদারের লেখা, সমর দাসের সুর করা—

“পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন সমুদ্রে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল”

গেরিলা যোদ্ধাদের তড়িৎ আক্রমণে পাকবাহিনী প্রায় নাজেহাল দশায় থাকত। মাত্র নয় মাসেই দেশ স্বাধীন হতো না, যদি এই তরুণ গেরিলারা বড় বড় অপারেশনগুলো চোখের পলকে সম্পন্ন করে দিয়ে না আসতেন। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সেই উত্তাল সময়ে যে গান প্রবল সাহস দিয়েছিল সেই গানটি আপেল মাহমুদই লিখেছিলেন এবং সুর করেছিলেন—

“তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
পাড়ি দিব রে
আমরা ক’জন নবীন মাঝি
হাল ধরেছি, শক্ত করে রে”

স্বাধীনতার অনেক বছর পর আজও গানটি সমানভাবে তরুণদেরকে প্রেরণা দেয়।

সে সময়ই গীতিকার নঈম গহরের লেখা আজাদ রহমানের সুরে ফিরোজা বেগম গাইলেন—

“জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো
এমন করে আকুল হয়ে
আমায় তুমি ডাকো
তোমার কথায় হাসতে পারি
তোমার কথায় কাঁদতে পারি
মরতে পারি তোমার বুকে
বুকে যদি রাখো আমায়
বুকে যদি রাখো মাগো”

সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণ আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখতে পারত না। সিকান্দার আবু জাফর সে বুঝেই হয়তো লিখেছিলেন—

“জনতার সংগ্রাম চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই
জনতার সংগ্রাম চলবেই”

পরে সুরকার শেখ লুৎফর রহমানের সুরে শিল্পীরা যখন সম্মিলিত সুরে এই গান গাইলেন তা এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

এ ছাড়াও যারা ট্রাকে করে ঘুরে ঘুরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে গান শুনিয়ে আসতেন তারাও সেইসব উত্তাল দিনকে রাঙিয়েছেন সুরের ঐশ্বরিক মূর্ছনায়। লিয়ার লেভিনের রেকর্ডকৃত ১১ টি গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানগুলি ছিল—‘পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘এই না বাংলাদেশের গান’, ‘আমার সোনার বাংলা’-সহ আরো অনেক অনেক দেশাত্মবোধক গান।

পুরো বিশ্ব জুড়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক যুদ্ধ সমন্ধে জানান দিতে এগিয়ে এসেছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর, জর্জ হ্যারিস, জোয়ান বায়েজের মতো শিল্পীরা। তারাও গানে গানেই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের কথা, আয়োজন করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর।

জোয়ান বায়েজ গেয়েছিলেন—

“Bangladesh, Bangladesh
when the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh”

বিটলস এর জর্জ হ্যারিসন গেয়েছিলেন—

“My friend came to me
with sadness in his eyes
told me that he wanted help
before his country dies...”

আশ্চর্যের বিষয় হলো পাকিস্তানিদের এই ধ্বংসতাণ্ডব বাঙালিরা মাত্র নয় মাসেই থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় ত্রিশ লক্ষ শহিদের হারিয়ে যাওয়ার শূন্যতা আজও দেশবাসী নিজেদের প্রত্যেকটি জাতীয় অর্জনেই সবচেয়ে বেশি অনুভব করে। তাই বিজয়ের মাস এলেই কানে বাজে—

“সব ক’টা জানালা খুলে দাও না
ওরা আসবে চুপি চুপি
যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে
দিয়ে গেছে প্রাণ”

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গীতিকার হিসেবে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, টি এইচ শিকদারসহ প্রমুখ গুণী ব্যক্তিত্ব।
আলতাফ মাহমুদ, সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুণ গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যটার্জী, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, কাদেরী কিবরিয়া, লাকি আখন্দ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, বুলবুল মহালনবীশ, ফকির আলমগীর, মকসুদ আলী সাই, তিমির নন্দী, মিতালী মুখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলমসহ আরো নানা শিল্পীর কণ্ঠে সে সময়ে গানগুলো পূর্ণতা পেত। শাহীন সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্য, মাহমুদুর রহমান বেনী, তারেক আলী, ডালিয়া নওশীন, শারমীন মোর্শেদ, লতা চৌধুরী, ইনামুল হক, স্বপন চৌধুরী, বেবী চৌধুরীসহ আরো নাম না জানা অনেক শিল্পীদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গান মুক্তির এই সংগ্রামে যোগ করেছিল একটি নতুন মাত্রা।

আজ ১৬ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেছন ফিরে তাকালে উত্তাল একাত্তরের সেই সংগ্রামের দিনগুলো যখন সামনে আসে তখন সম্মুখ সমর শেষে একটি মাত্র রেডিওকে খুব কম সাউন্ডে কানের কাছাকাছি এনে মুক্তিযোদ্ধাদের সেইসব জ্বালাময়ী গান শোনাকে কেমন স্বপ্ন মনে হয়।

যদি স্বাধীনতা একটি দেশের প্রাণ হয় সংস্কৃতি তার সৌন্দর্য। সংস্কৃতিকে বুকে আগলে স্বাধীনতার লড়াই মুক্তিযুদ্ধকে যে মহান আবেগের বস্তু বানিয়েছিল, সে ঘটনাই জাতি হিসেবে আমাদের চূড়ান্ত দেশপ্রেমের নিদর্শন।

“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না”

গানে গানে মুক্তিযোদ্ধাদের এই মহান আত্মত্যাদের স্বীকৃতি কিন্তু সংগীত শিল্পীরাই প্রথমেই দিয়েছিলেন। সম্মুখ সমর থেকে তাদের লড়াই যে কোনো অংশ থেকে কম ছিল তাও নয়। এখন সেসব জাগরণের গানের সঠিক সংরক্ষণই এই প্রজন্মকে আলোর পথের রাস্তা দেখিয়ে স্বাধীনতার সম্মান ধরে রাখার শক্তি এবং তা আগলে রাখাসূচক গর্বের স্বরূপ কী তা পূর্ণাঙ্গ ভাবে দেখাতে পারে। প্রজন্ম সেদিকে মনোযোগী হবে সে আশাই রইল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর