সাজানো গোছানো ফরিদপুর থেকে ঘুরে আসলাম দিন দুয়েকের জন্য। শীতের আমেজ যেন জেলাটির সৌন্দর্য আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই ফরিদপুরেই, তারা প্রায় সকলেই এক নামেই ‘অনাথের আচার’ চেনেন।
বলছিলাম ফরিদপুরের ঝিলটুলি এলাকার অনাথের আচারের কথা। ভীষণ পরিচিত অনাথের আচারের খোঁজে এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম। দোকানটি খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। স্থানীয় যে কোন রিকশা কিংবা অটো চালক এক নামেই দোকানটি চিনেন।
কিন্তু দোকানের সামনে গিয়ে কিছুটা অবাক হতে হলো, সাথে হতাশও। দোকানের নাম অনাথের আচার হলেও, আদতে দোকানটি সাধারণ একটি মুদি দোকান। কোন ভুল হলো কিনা ভাবতে ভাবতেই দোকানে উপস্থিত লোকের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করলাম। জানলাম কোন ভুল হয়নি। জৌলুসবিহীন এই মুদি দোকানটিই বিখ্যাত অনাথের আচারের দোকান!
দোকানে যিনি ছিলেন, তিনি এই অনাথের আচারের প্রতিষ্ঠাতা অনাথ লাল সিংহের একমাত্র ছেলে শংকর লাল সিংহ। ১৯৯৮ সালে অনাথ লাল মারা যাওয়ার পর থেকে তার হাত ধরেই চলছে অনাথের আচার। বাবার কাছ থেকে শিখে রাখা প্রক্রিয়াতে, পুরনো আদলেই তৈরি করেন অনাথের নামে খ্যাত অনাথের আচারকে। তার সঙ্গে গল্পে উঠে আসে অনাথের আচারের বর্তমান সময়ের অসহায়ত্বের গল্প।
অনাথের আচারের দোকানে শুরু থেকেই পাওয়া যায় তিন ধরণের আচার। তেঁতুল, বড়ই ও জলপাইয়ের মিষ্টি আচার। ছোট আচার প্রতি প্যাকেট পাঁচ টাকা। সঙ্গে আছে ১০০ টাকা ও ২০০ টাকার বোয়ামও। তবে আগে পাইকারি হারে আচার বিক্রি করা হলেও, বর্তমানে আচারের বেচাকেনা শুধুই খুচরা বিক্রির মাঝেই সীমাবদ্ধ।
কারণ জানতে চাইলে শংকর লাল সিংহ জানালেন, আগের দিন আর নেই। ব্রিটিশ আমলের অনাথের আচারের সঙ্গে বর্তমান সময়ের অনাথের আচারের মিল খোঁজা হবে বোকামি। আগেকার সময়ের মতো ফ্রেশ ও ভালো মানের ফল পাওয়া হয়ে গেছে কষ্টসাধ্য। আগে যেখানে কানাইপুর হাটে এক কেজি বড়ই পাওয়া যেত দুই টাকা দরে, সেখানে ৪০-৫০ টাকাতেও ভালো মানের বড়ই পাওয়া কষ্টকর বিষয়।
শুধু বড়ই, তেঁতুল কিংবা জলপাই নয়, বহু গুণে দাম বেড়েছে অন্যান্য সকল কাঁচামালের। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে আচারের দামটাও বাড়তি ধরতে হয়েছে। হু হু করে বেড়ে যাওয়া দামের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েই হিমশিম খেতে হয়েছে অনাথের আচারকে। পুরনো দিনের ক্রেতারা এখনও অনাথের আচারকে পুরনো দামেই কিনতে চান। এতে করে লাভের মুখ দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে বলে দুঃখপ্রকাশ করেন শংকর।
কথা বলার মাঝে নিজ থেকে জলপাইয়ের আচারের ছোট দুটো প্যাকেট যত্ন করে হাতে তুলে দিলেন তিনি। আচার মুখে দিয়েই বোঝা যায়, অনাথের আচারের বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব। গল্প এগোতে থাকলে শংকর আফসোস করে জানান, আগে গাছপালা ছিল অনেক বেশি। সেই সঙ্গে পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণ ভালো ফল। আর এখন গাছের পর গাছ কেটে তৈরি করা হচ্ছে বাড়ি-ঘর, দোকানপাট। জলপাইয়ের মৌসুমে কিছুটা ভালো জলপাই পাওয়া গেলেও, ভালো মানের তেঁতুল ও বড়ই পাওয়া খুবই কষ্টকর।
এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির আচারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অনাথের আচারকে পেছনে পড়ে যেতে হয়। ক্রেতারা আগেকার সময়ের আচারের স্বাদ, মান ও দামকে খোঁজে। স্বাদ ও মান ধরে রাখলে চাইলে দামটা যে বেড়ে যাবে, সেটা আর মানতে চাননা। সমস্যাটা এখানেই।
তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আচারের পাইকারি বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন শংকর। খুচরা আচার বিক্রির পাশাপাশি শুরু করেছেন মুদি দোকানের ব্যবসা। জানতে চেয়েছিলাম, পরিবারের কারোর সাহায্য পান কিনা। উত্তরে তিনি জানান, তার স্ত্রীর সহায়তা ও সাহায্যের জন্যে ছোটখাটো ভাবে হলেও এখনও পর্যন্ত আচার বিক্রি করতে পারছেন।
গল্পে সময় গড়ালে ফেরার প্রস্তুতি নিতে হয়। যাবার আগে প্রশ্ন করলাম, ‘অনাথের আচারের ভবিষ্যৎ কী’? উত্তরে শংকর বলেন, ‘যতদিন সম্ভব চেষ্টা করবো আচার বানায়ে যাওয়ার, আচার বিক্রি করার। কোনদিন যদি একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে তো আর কোন উপায় থাকবে না। তখন বন্ধই করে দিতে হবে অনাথের আচারকে। কারণ আমার তো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। আমার দুইটা ছেলেকে মানুষ করতে হবে’।
এমন রূঢ় বাস্তবতাকে অকপটে বলার সময়ে শংকরের চোখের কোন ভিজে উঠেছিল কি? হতে পারে। কিন্তু আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, চলে না সংসার। নিভু নিভু প্রদীপের শেষ আলোটুকুকে সম্বল করে এখনও অনাথের আচারকে আঁকড়ে ধরে রাখা মানুষটি জানে, কতটা ভালোবাসা, স্মৃতি, মমতা ও শ্রদ্ধা জড়িয়ে আছে তার বাবার হাতে গড়ে ওঠা অনাথের আচারের সঙ্গে। কিন্তু দিন শেষে অসহায় হয়ে যেতে হয় কঠিন বাস্তবতার সামনে।