কাশীনাথ রায় স্যারের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে ভাবিনি। সর্বশেষ দেখা হয়েছিল প্রায় চৌদ্দ বছর আগে। স্যারের ফুলার রোড়ের বাসায়। গত সোমবার হুট করে স্যারকে পেলাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাত তলায় জীবনানন্দের পাশে স্যার লুকিয়ে ছিলেন তিনি! ঠিক বেঁচে থাকতে স্যার যেমন নিভৃতচারী ছিলেন।
বাতিঘরের বইয়ের তাকে ‘জীবনানন্দ দেখুন’ নামে স্যারের বইটি পেলাম। এই বইটি দেখে মনে হলো স্যারকে আবার দেখলাম। সেদিন সেখানে সজীব মিয়া, মিলি আপাদের দেখালাম কাশীনাথ রায় স্যারকে। বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই কাশীনাথ রায়ের কোনো প্রতিষ্ঠা বা পরিচিতি নেই। কুণ্ঠিত চিত্তে যা তিনি বলতে চান, সে তার পিতৃভূমির ভাগ্য-দুর্ভাগ্য নিয়ে নির্বোধ মমতা, উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার কথা। যদি কোনো সদয় কাব্য-রসিক, কোনো সহৃদয় শ্রোতা সে কথা শুনতে রাজি হন, তাহলে কাশীনাথ রায় কৃতার্থ বোধ করবেন।
শেষ ফ্ল্যাপে স্যারের একটা ছবি; নিচে লেখা,
জন্ম: নাটোর, ১৯৪৭
পেশায়: শিক্ষক
এছাড়া আর কিছুই লেখেননি।
বইতে নরম শব্দে ছোট ছোট ৩৪টি কবিতা লিখেছেন স্যার। কবিতায় সমসাময়িক কালের কথা। দেশের জন্য চিন্তা-দুশ্চিন্তা। প্রেম, আক্ষেপ, প্রকৃতি, বৃক্ষ, পুষ্প আর স্যারের জন্মভূমি চলনবিলের ইচ্ছাপুর গ্রামের কথা বলেছেন।
স্যার ক্লাসে শান্ত ছিলেন। অদ্ভুত সুন্দর নরম স্বরে কথা বলতেন। পরতেন সাদা পাঞ্জাবি। এমন শান্ত-শিষ্ট, সুন্দর সুপুরুষ একজন বিদ্বান মানুষ সারাজীবন নিভৃতেই ছিলেন। স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। খুব সম্ভবত ছেলের কনভোকেশন বা এরকম কোনো কারণে একবার লন্ডন গিয়েছিলেন। এটাই স্যারের একমাত্র বিদেশ সফর।
স্যার দেশেও যে খুব বেশি ঘুরেছেন তেমন নয়। তবে স্যারকে দেখেছি তার শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে হৃদয়ে ঘুরতে। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের সুখ দুঃখের খবর তিনি পেয়ে যেতেন সেই সূত্রেই স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়।
আমার একজন মেধাবী বন্ধু স্যারের ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলেন। আমার বন্ধুর আর্থিক অনটন ছিল। এতো এতো শিক্ষার্থীর ভিড়তে এই তথ্য স্যারের নজরে ছিল। স্যার আমার বন্ধুকে উৎসাহ দিতেন। পরম মমতায় আগলে রাখতেন।
মেধা আর পরিশ্রমে স্যারের মতো মহান মানুষের ছাত্র হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। তবে একটা সুযোগ ছিল। তখন ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে কয়েকটি কোর্স ছিল যেখানে বাইরের যে কেউ ভর্তি হতে পারৎ। সেই সুযোগে আমি স্যারের দুইটি ক্লাস করার সৌভাগ্য অর্জন করি। ক্লাসের সুবাধেই স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে লেকচার শুনতাম। স্যারের সবচেয়ে বড় গুণ তার দরদ। এমন দরদী মানুষ, মোহনীয় মানুষ দুনিয়ায় বিরল।
বন্ধুর সাঙ্গে আমরা কয়েকদিন স্যারের বাসায় গিয়েছি। সময়ে অসময়ে আমরা হাজির হতাম। দুপুরে ভাত খেয়ে স্যার হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কলিং বেলের শব্দে তিনি উঠে আসতেন। কখনোই বিরক্ত হতেন না। দরাজ দিলে কথা বলতেন। স্যারের কথা যেন মুক্তোর মালা। কখনো স্যারের বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ের কথা, কখনো ৬০/৭০ সনে ঢাকা কেমন ছিল সে কথা। বরিশালের বালাম চালের বর্ণনা। স্যার বলেছিলেন চলনবিলের ইচ্ছাপুর গ্রামে জন্মেছিলাম আমি আমার গায়ে পলি মাটির গন্ধ ছিল।
২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি রোববার ঘুম থেকে উঠে শুনি স্যার নেই। যারা স্যারকে দেখেছেন এবং স্যারের সাহচর্য পেয়েছেন তাঁরা জানেন এমন মানুষের মৃত্যু নেই। হয়তো খুব বেশি আলোচনায় তিনি নেই। তবে নিভৃতচারী এই শিক্ষককে বিষন্ন বিকেলের নরম রোদে ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে জীবনানন্দের রূপসী বাংলার পাশে।
শিক্ষক দিবসে কাশীনাথ রায় স্যারের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা নিভৃতচারী সকলের শিক্ষকের প্রতি।