পুরনোদের সন্ধানে: দীর্ঘজীবী গাছের রহস্যভেদ ও কোথায় পাওয়া যায়

, ফিচার

আসমা ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-10-20 18:00:21

সাইকামোর গ্যাপ ট্রি বা রবিন হুড ট্রি। ইংল্যান্ডের নর্থম্বারল্যান্ডে ক্র্যাগ লফের কাছে হ্যাড্রিয়ানের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাইক্যামোর গাছটির বয়স ছিল ২০০ বছরেরও বেশি। গাছটি দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় গাছগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৯১ সালে ‘রবিন হুড: প্রিন্স অফ থিভস’ চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দৃশ্যে এই গাছটিকে দেখানো হয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালের ইংল্যান্ডের ‘ট্রি অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার জিতে নেয় সাইকামোর গ্যাপ ট্রি ।

কিন্তু, অন্তত দুঃখের বিষয় হলো গত ২৮ সেপ্টেম্বর ভোরে গাছটি কেটে ফেলা হয়। এই ঘটনাকে কর্তৃপক্ষ নাশকতা (অ্যান অ্যাক্ট অব ভেন্ডালিজম)’ দেখছেন। এদিকে গাছটি কেটে ফেলায় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ ও বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে। সাইক্যামোর গ্যাপ ট্রি রোমান স্থাপত্যকে মনে করিয়ে দিত। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, শাখা- প্রশাখা থেকে আবারও পুনরুত্থিত হবে সাইক্যামো। কিন্তু তা আর হতে দেওয়া হলো না।

পৃথিবীর প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে, মাত্র ২৫-৩০টি মানুষের সহায়তা ছাড়াই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। এসব গাছ ১ হাজার বছর বা তার বেশি বয়স পর্যন্ত পৌঁছায়। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১০টি প্রজাতি ২ হাজার বছর বাঁচে। এই সুপারমর্টাল গাছগুলো মধ্যে শুধুমাত্র তিনটিই ত্রিশ হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।

স্কটল্যান্ডের পার্থশায়ারের ফোর্টিংগাল গ্রামে গির্জার বাগানে বেড়ে ওঠা ইয়ুকে গাছকে যুক্তরাজ্যের প্রাচীনতম জীবন্ত গাছ

ঐতিহাসিক ডকুমেন্টেশনের অনুপস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা কিভাবে জীবের বয়স বের করেন সে প্রসঙ্গে আসা যাক। গাছের বয়স মাপার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান কৌশল রয়েছে।
প্রথম কৌশলটি হলো একের পর এক বৃদ্ধির রিং গণনা করা। এটি একটি স্টাম্প দিয়ে করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাটা গাছের প্রয়োজন হয়। ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ব্যতীত ট্রি-রিং বিজ্ঞানীরা (ডেনড্রোক্রোনোলজিস্ট) গাছগুলোকে কেটে ফেলেন না। এর পরিবর্তে তারা একটি মূল নমুনা বের করেন। ট্রি-রিং কোর নমুনাগুলো আইস কোরের সাথে তুলনীয়। এক্ষেত্রে ভেতরের স্তরগুলোকে অতীতের পরিবেশগত অবস্থার পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যা জলবায়ু গবেষণার জন্য অমূল্য।

কিন্তু খুব কম গাছই সেই চাহিদা পূরণ করে। প্রায় সব গাছের কাঠ সময়ের সাথে সাথে ফাঁপা হয়ে যায়। সবচেয়ে অ্যান্টিসেপটিক পরিবেশেও শুধুমাত্র সবচেয়ে রজনীক হার্টউড শতাব্দী পরেও ক্ষয় হয় না। ফলে বৃক্ষ-রিং বিজ্ঞানীরা অন্যান্য বাধার সম্মুখীন হন। দৈত্যাকার সিকোইয়ার মতো কিছু প্রাচীন গাছকে খুব পবিত্র মনে করেন স্থানীয়রা । এতে বিজ্ঞানীদের মূল নমুনা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না।

এক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদদের জন্য দ্বিতীয় কৌশল হতে পারে রেডিও-কার্বন ডেটিং। এই কাজ করার জন্য একটি ফাঁপা গাছ প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে গাছটির অভ্যন্তরীণ কাঠের গঠনে কিছু প্রাচীন উপাদান অবশিষ্ট থাকে যা পর্যালোচনা করা হয়। কার্বন-১৪ ডেটিং গাছগুলোর কোনো বৃদ্ধির রিং বা কাঠ তৈরি করে না।

তৃতীয় কৌশলটি আকার এবং আকৃতি পর্যালোচনা (রূপবিদ্যা)। গাছের আকার আকৃতি থেকে বয়স অনুমান করা হয়। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ট্রাঙ্কের ব্যাসকে একটি নির্দিষ্ট ফ্যাক্টর দ্বারা গুণ করে আর্বোরিয়াল বয়স গণনা করা হয়। সূত্রটি কম-বেশি জটিল এবং নির্ভুলও হতে পারে। নির্দিষ্ট আবাসস্থলে প্রজাতির বৃদ্ধির অভ্যাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। এই পদ্ধতি জ্ঞানের স্তর এবং বৃক্ষ-রিং ডেটার সাথে সম্পর্কিত তথ্যের উপলব্ধতার উপর নির্ভর করে।

ফিরে আসি বিস্তারিত আলোচনায়। প্রাচীন ফ্লোরা (পুরানো গাছ) এবং মেগাফ্লোরার (বড় গাছ) পূজা করার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। তাদের পুড়িয়ে মারারও লম্বা ইতিহাস রয়েছে। ২০০ বছর বয়সী উদ্ভিদ সাইক্যামোর গাছটিও তারই ভুক্তভোগী।

বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদের আরেকটি প্রজাতি ইউরোপীয় ইউ। এটি গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রজাতি। বহু শতাব্দী ধরে শেখা ব্রিটিশদের সনাতনী প্রচেষ্টা এর বয়স নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে।

ইয়ু চিরসবুজ গাছ হিসাবে পরিচিত। ইয়ুকে অনন্তজীবন এবং পুনর্জন্মের প্রতীক মানা হয়। প্রাক-খ্রিস্টীয় সময়ে এটি পবিত্র গাছ হিসেবে পরিচিত ছিল। সে সময়ে ইয়ুকে প্রাচীন সেল্টদের জন্য মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের প্রতীক হিসাবে মানা হতো। এই ধারণা খ্রিস্টীয় যুগেও অব্যাহত ছিল। বহু শতাব্দী ধরে আরাধনায় এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ইয়ু গাছের কাণ্ড ব্যবহার করা হতো। আজও প্রাচীন এই ইয়ু গাছগুলো প্রায়শই চার্চইয়ার্ডের সাথে যুক্ত।
প্রাচীন এই গাছগুলো পৃথিবীর কোন এলাকায় পাওয়া যায়?

সাধারণত চার্চইয়ার্ড, কবরস্থান, আর্বোরেটা এবং ম্যানর বাগানগুলোতে এই চিরসবুজ ল্যান্ডমার্ক দেখার সুযোগ হয়। অথবা বিচ্ছিন্ন বনাঞ্চল বা পাহাড়ী আবাসস্থলগুলোতেও দেখা মিলতে পারে। গির্জা, উপাসনালয় এবং মন্দিরের মতো পবিত্র স্থানগুলোতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এরা বেঁচে থাকে। পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, ইরান, ইথিওপিয়া, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ এবং মেক্সিকো জুড়ে এদের পাওয়া যায়। জয়া শ্রী মহা বোধি, শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরায় বৌদ্ধ তীর্থস্থানের কেন্দ্রে ফিকাস দেখা যায়। সম্ভবত একই লোকেলে একই জার্মপ্লাজমের ধারাবাহিকতার পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত উদ্ভিদ এটি।

গ্রেট বেসিন ব্রিস্টেলকোন পাইনকে প্রাচীনতম জীবন্ত গাছ বলে মনে করা হয়

গ্রেট বেসিন ব্রিস্টেলকোন পাইন গাছ পাওয়া যায় নিউ মেক্সিকোর এল মালপাইস (লাভার ক্ষেত্র), অন্টারিওর নায়াগ্রা এসকার্পমেন্ট (ডলোমাইটের ক্লিফস) বা নিউ জার্সির পাইন ব্যারেন্স (বালির বিস্তৃতি) এর মতো সাবমার্জিনাল আবাসস্থলগুলোতে। পূর্ব উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘজীবী এই ব্রিস্টেলকোন পাইন গাছ (টাক সাইপ্রেস) জলাভূমি এবং ব্ল্যাকওয়াটার নদীতে জন্মায়। সবচেয়ে বড় গাছটি উত্তর ক্যারোলিনার ব্ল্যাক রিভারের ব্যাকওয়াটার অংশে জন্মে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত টাক সাইপ্রেসটির বয়স প্রায় ২ হাজার ৬০০ বছরে পৌঁছেছে।

জিমনোস্পার্ম (নগ্ন বীজী/ ফুলবিহীন গাছ) আস্তে আস্তে বড় হয়। অ্যাঞ্জিওস্পার্ম (ফল সহ ফুলের গাছ) এর চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। পাইনের জন্য আনুমানিক বয়স সীমা ৫ হাজার বছর। কিছু প্রজাতির জন্য সেটা ৮০০ বছর প্রায়। এনজিওস্পার্মের মধ্যে, বয়সে চ্যাম্পিয়ন হল আফ্রিকান বাওবাব যা প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছর ধরে বেঁচে থাকতে সক্ষম। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাচীনতম অনেক গাছ ভেঙে গেছে।
জিমনোস্পার্মের মধ্যে রয়েছে জিঙ্কগো (একটি প্রজাতি) এবং শঙ্কু প্রজাতি। আরও রয়েছে ইয়ু, পাইন, ফিয়ার, স্প্রুস, সিডার, রেডউডস, সাইপ্রেস, পোডোকার্পস এবং অ্যারোকেরিয়াস। সাইপ্রেস পরিবারে সর্বাধিক হাজার বছরজীবী সদস্যও রয়েছে।

কনিফারগুলো সর্বাধিক দীর্ঘায়ু অর্জন করে যখন পরিবেশ ঠান্ডা এবং শুষ্ক, বা গরম এবং শুষ্ক, বা খাড়া এবং উন্মুক্ত, বা উচ্চ উচ্চতায়, বা পুষ্টির অভাব হয়। গ্রেট বেসিন ব্রিস্টেলকোন পাইন (সবচেয়ে দীর্ঘজীবী উদ্ভিদ) উপরের সবগুলো পরিবেশেই টিকে থাকে। এদের মধ্যে কিছু গাছের বয়স ৪ হাজার ৯০০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। ট্রি-রিং বিজ্ঞানী এডমন্ড শুলম্যান ১৯৫০ এর দশকে ‘প্রতিকূলতার অধীনে দীর্ঘায়ু’ নামের একটি উপযুক্ত ম্যাক্সিম তৈরি করেছিলেন। সেখানেই পাইন সম্পর্কে এই তথ্য পাওয়া যায়।

আফ্রিকার বাওবাব গাছ (সাভানা ল্যান্ডস্কেপে বসবাসকারী প্রাণীদের ছায়া প্রদান করে)

জলবায়ু পরিবর্তন কি এই সুপারমর্টালদের প্রতিকূলতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেবে?

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা প্রকৃতপক্ষে ব্রিস্টেলকোনের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। তবে সম্প্রতি উত্তাপ, খরা এদের মৃত্যুর ঠেলে দিচ্ছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।

প্রতিকূল বাসস্থান ছাড়াও এদের দীর্ঘ জীবনের পেছনে শক্তিশালী রাসায়নিক সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী কনিফারগুলো প্রচুর রজন তৈরি করে। এগুলো টেরপেনের মতো উদ্বায়ী, সুগন্ধযুক্ত হাইড্রোকার্বন যা ছত্রাক এবং পোকামাকড়ের আক্রমণকে প্রতিহত করে। গাছগুলো শুষ্কতা এবং ঠান্ডা সহ্য করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী চাপে কনিফারগুলো ধীরে ধীরে আরও রজন মজুত করে। এই ধীরগতির বৃদ্ধি আরও জৈব পলিমার (লিগনিন) তৈরি করে যা উদ্ভিদকে আরও স্থিতিস্থাপক করে তোলে।

নিউজিল্যান্ডের কৌরি গাছ (শুধু পুরানোই নয়, বিশালও)

হাজার বছর ধরে টিকে থাকে এমন উদ্ভিদ দেখার সেরা জায়গা কোথায়?

পশ্চিম উত্তর আমেরিকা অঞ্চল (বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া) হতে পারে দীর্ঘায়ু উদ্ভিদদের উল্লেখযোগ্য হটস্পট। তাসমানিয়াও তাই। হুওন পাইন হলো তাসমানিয়ার স্থানীয় প্রজাতির মধ্যে একটি হাজারবর্ষী উদ্ভিদ।

দীর্ঘজীবী সব জীবই উদ্ভিদ নয়। দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা সমস্ত উদ্ভিজ্জ রূপকে জনপ্রিয়ভাবে বৃক্ষ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় না। জলবায়ু পরিবর্তন চলতে থাকলে, মেগাফ্লোরা বিরল হয়ে উঠবে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এসব জীবের পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। তাহলেই সাইকামোর গ্যাপ ট্রির মতো অন্যান্য বহুবর্ষজীবীদের কেটে ফেলার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখতে হবে না।

সূত্র: বিবিসি

এ সম্পর্কিত আরও খবর