বসন্তের আগাম দোলায় কাপ্তাই

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 05:42:22

চলে যাওয়ার আগে শীত অতি সন্তর্পণে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। সমতল আর পাহাড়ের সন্ধিস্থল কাপ্তাইয়ে এসে টের পাওয়া গেলো শীত বিদায়ের টান আর বসন্তের আগাম দোলা।

শুক্রবার ( ৮ ফেব্রুয়ারি) ভোরে লেক আর পাহাড় ঘেরা কাপ্তাই স্বাগত জানালো নাতিশীতোষ্ণ মখমল বাতাসের পরশে। 'শেষ রাতে একটু ঠাণ্ডা পড়ে। শীত বলতে এতটুকুই বাকি আছে', বললেন কাপ্তাই প্রকৌশল একাডেমীর উপ-পরিচালক শাহরিয়ার হোসেন মজুমদার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক আবু তাহের মজুমদারের পুত্র শাহরিয়ার পড়েছেন নৃতত্ত্ব। বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞান চর্চার প্রথম ব্যাচের ছাত্র তিনি জাহাঙ্গীরনগরের ১৫তম ব্যাচ। বললেন, 'চন্দ্রঘোণা-কাপ্তাই থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোঁয়া শুরু। হ্রদের অপর পাশের পুরোটাই পার্বত্যাঞ্চল।'

চারপাশে তাকালেই অনুভব করা যায় পার্বত্য প্রকৃতির মহিমা। পুরো জনপদ ধনুকের মতো ঘিরে রেখেছে সুবিশাল লেক। লেকের স্থির জলে বিম্বিত হচ্ছে সুনীল আকাশ ও সবুজ প্রকৃতি।

'শীতের সময়ে লেকে পানি কম থাকে। বর্ষায় জলের ধারায় টইটুম্বুর হয়ে থাকে কাপ্তাই লেক বা কৃত্রিম হ্রদ' বললেন শাহরিয়ার।

মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মধ্য ষাট দশকে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি করা হয়। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটটিও কাপ্তাইয়ে। কর্ণফুলী নদী থেকে সৃষ্ট জলাধারটির সিংহভাগ কাপ্তাই ও রাঙামাটির মাঝে। বাকি অংশ কাপ্তাই থেকে রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী হয়ে চট্টগ্রাম শহর ছুঁয়ে সাগরে মিশেছে।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কয়েকটি সরকারি স্থাপনা পেরিয়ে খালি জায়গা পেয়ে লেকের জল স্পর্শ করতে ইচ্ছে হলো। অনেকটুকু পথ তীক্ষ্ণ ঢাল পেরিয়ে নিচে পাওয়া গেলো পানির সাক্ষাত। লেকের ঢালে বিবর্ণ লতা-গুল্মের শরীরের সবুজ, হলুদ, গোলাপি রঙের হালকা প্রলেপ জানিয়ে দিল, 'বসন্ত আসছে'।

শীত ঋতুর শেষ সপ্তাহটি চলে এসেছে বসন্তের অংশে। পত্র, পল্লব, পুষ্প, বিটপীর শরীরের বাসন্তিক ছোপ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। লেক ঘেরা পাহাড়ি বনানীতেও লেগেছে রঙের আগুন। শুষ্ক ও শীতার্ত বৃক্ষের কাঠামোয় চলছে আমূল পরিবর্তন। ঋতুর পালাবদলে বদলাচ্ছে প্রকৃতি ও উদ্ভিদ। এলোমেলো বইছে তরতাজা বাসন্তী বাতাস।

পার্বত্য জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে দেখা গেলো লেকের তীর ঘেঁষা কাঁচা বসতিতে। আদিবাসী পোশাকে অবাক তাকিয়ে আছে লোকগুলো। আর আছে লাউড স্পিকারে অতি উচ্চশব্দে হিন্দি গান বাজিয়ে চলাচলকারী পিকনিক পার্টির বাস, মিনিবাস।

এখন চলছে পিকনিকের পিক সিজন। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ক্লাবের ব্যানার ঝুলিয়ে শহরের অনেক পিকনিক পার্টি এসেছে কাপ্তাইয়ে। খাওয়া-দাওয়া আর জোরে চটুল হিন্দি গান বাজানো হয়ে গেছে পিকনিকের ট্রেডমার্ক। ভ্রমণের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক আড়াল করছে প্রচণ্ড শব্দ দূষণ।

'শনিবার এখানে সাপ্তাহিক হাট বসে। পাহাড়িরা নানা সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হয়।' জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও প্রকৌশল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মুখোমুখি কমপ্লেক্সের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন সাইফুল ইসলাম।

ট্রাকে ট্রাকে উজাড় হচ্ছে বনজ সম্পদ, কাঠ ও বাঁশ, ছবি: বার্তা২৪.কম

 

'এটিই এখানকার প্রধান সড়ক। চট্টগ্রাম থেকে হাটহাজারী ও রাউজানের দক্ষিণাংশ ছুঁয়ে রাঙ্গুনিয়া চন্দ্রঘোনা হয়ে কাপ্তাই লেক পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে রাস্তাটি’, জানান সাইফুল। তিনি একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশেই কাপ্তাইয়ের মূল অংশ। রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য ট্রাক। লেকের অপর তীরের পার্বত্য রাঙ্গামাটি থেকে বাঁশ ও গাছের সরবরাহ নিয়ে ট্রাকগুলো চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করছে।

'অবাধে বনজ সম্পদ উজাড় হচ্ছে অসাধুচক্রের পৃষ্ঠপোষকতায়', সাইফুলের কণ্ঠে ক্ষোভ। সবাই প্রকৃতির নিধন দেখেও কিছু করছে না বলে ক্ষুব্ধ তিনি।

ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশেই বাস স্টপেজ। বিভিন্ন বাস কোম্পানির অফিস রয়েছে চারপাশে। অস্থায়ী দোকান, চা স্টল, ভাতের হোটেল দেখা গেলো। রাস্তার শেষে সামনেই লেকের সীমানা। সেখানে জেটি। জলপদে রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথের শুরু এখানেই।

জল, জঙ্গল, বৃক্ষ শোভিত কাপ্তাই জনপদটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার যোগ্যতা রাখে। পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের অভাবে সেটা আর হলো না। হতশ্রী অবয়বে কাপ্তাই যেন না-শহর, না-গ্রাম। উন্নয়নের দেশময় তোড়ে কাপ্তাই পড়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক ক্রান্তিকালে।

ফিরে আসার পথে আমাদের রাস্তার সমান্তরালে চলা নদী, অদূরের প্রকৃতি, নিঝুম নিসর্গ আর কয়েকটি অনামা পাখি যেন করুণ সুরে বলছিল নান্দনিক জনপদের অন্তর্গত বেদনার কথা। পশ্চিমের দিগন্তে ঢলে পড়া সূর্যের মায়াবী আলো আদিম আরণ্যক জনপদের সুবিশাল শরীরে রঙের ঢেউ ছড়িয়ে মহীয়ান করে তুলেছিল কাপ্তাইকে। শত কষ্ট আর অবহেলার পরেও কাপ্তাই তবুও বার বার জানিয়ে দিচ্ছিল বসন্তের বাহার। শুনাচ্ছিল ঋতুরাজ বসন্তের আগাম আগমনী।

এ সম্পর্কিত আরও খবর