বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলা শেষ হলে একটি পরিসংখ্যান বের হয়। তাতে কত টাকা বিক্রি হয়েছে সে তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে থাকে। আর থাকে গল্প, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি কোনো ধরনের বই কতটি বের হয়েছে, সে তথ্য।
একেবারেই সাদামাটা তথ্য সেগুলো। মোটেও বিশ্লেষণ থাকে না সেসবে। মেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বইগুলোর মান ও গুণ বিচার করে কিছু বলা হয় না সেসব তথ্যে। না বলার কারণ দুটি। একটি হলো সে বিশ্লেষণের যোগ্য লোকের অভাব। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক বা অন্যবিধ পক্ষপাতিত্বের কারণে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ হওয়া সম্ভব হয় না।
অথচ এটা জানা দরকার যে, কোনো বছরের সময় সীমায় প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে কোন কোনটি গুরুত্বপূর্ণ। এবং কি কারণে তা গুরুত্বের দাবি রাখে। সাধারণ পাঠকের পক্ষেও ভালো বই আর মন্দ বই চেনা সম্ভব হতে পারে এর দ্বারা।
মন্দ বই শব্দটি বলা হয়ত উচিত নয়। কিন্তু মেলার আগে অসম্পাদিত, ভুলে ভরা, এক কপিও বিক্রি হয় না যে বই, তাকে কি নামে অভিহিত করা উচিত? নিজের পয়সায় বই বের করে আবর্জনার স্তূপ বাড়ালে কার লাভ? এ ধরনের অপচয়ের ফলে খোদ প্রকাশক কাম লেখকেরও আদৌ কোনো লাভ হয় না।
বইমেলা যে কেবল বাণিজ্যের স্থান নয়, বইয়ের বিকাশের ক্ষেত্রও, সেটাই মনে হয় দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছে। আত্মপ্রচারের যে মচ্ছব মেলায় চলে তাতে বইমেলার চরিত্রই বিনষ্ট হওয়ার দশা। আয়োজনের সঙ্গে জড়িত বাংলা একাডেমী ও বিক্রেতা সমিতি বুকে টোকা দিয়ে কিছু বইকে গুণের কারণে প্রশংসা করতেই পারে। কিন্তু সেটাও করা হয় না।
ফলে দেখা যায় হাজার হাজার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে গল্প, উপন্যাস, কবিতা থৈ থৈ করছে। গবেষণা, প্রবন্ধ, অভিধান তেমন থাকছে না। শুধু গল্প, কবিতায় একটি দেশের প্রকাশনা উন্নত হয় না। জ্ঞান ও মেধার উপযোগী বইও তালিকায় থাকতে হয়। তা খুব কমই থাকে। ফলে বাংলা ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো প্রকাশনার অভাব শুধু বেদনাবহ-ই নয়, দুঃখজনকও বটে।
বিপুল অসম্পাদিত ও ভুল প্রকাশনাসমূহের ক্রমবর্ধমান বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মান ও গুণ বিধান করা অপরিহায। কিন্তু সেটা করবে কে? কে কাকে মানবে? অথচ এমনটি না করা হলে হাজার হাজার বই বের হবে এবং তাতে ভাষা ও সাহিত্যের আদৌ কোনো লাভ হবে না। কাগজ, কালি, ছাপাখানা, অর্থ ইত্যাদির বিস্তর অপচয় হতেই থাকবে।
একটি সৃজনশীল প্রকাশনা জাতির মেধা ও মননকে বিকশিত করতে সক্ষম। ভুল বা অসম্পূর্ণ প্রকাশনা তা পারবে না। ভালো বই ও মানহীন বইয়ের একটি তারতম্য পাঠকের সামনে না থাকলে পাঠক কাজের ও অকাজের বইকে পার্থক্য করতে পারবে না। এদেশে বইয়ে কোনো বিবরণমূলক আখ্যান প্রকাশকরা সরবরাহ করেন না। বইটি সম্পর্কে কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মতামতও রাখা হয় না। কোনো মূল্যায়নকারী বা সম্পাদনাকারী বইটির আদ্যোপান্ত দেখেও দেন না। ফলে তাতে গলদ থাকেই।
একজন লেখক, যত উচ্চাঙ্গেরই হোন না কেন, মানবিক কারণেই তিনি কিছু ভুল করতেই পারেন। সে ভুল বানানের, ভাষার, উপস্থাপনার ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে হতে পারে। যেসব ভুল শুধুমাত্র একজন প্রুফরিডারের পক্ষে যথাযথভাবে সংশোধন করা সম্ভব হয় না। অথচ লেখককের পাণ্ডুলিপি মাত্র একজন প্রুফরিডারের হাত গলে ছাপা হয়ে যায়। সে প্রুফরিডার আবার কাজের চাপে স্রোতের মতো চোখ বুলিয়ে কিছু বানান সারিয়েই নিজের কাজ শেষ করেন!
ভালো বই ও ভালো প্রকাশনার জন্য যে পরিমাণ সময় ও যে জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, সেটা এদেশে এখনো প্রতিষ্ঠা পায় নি। প্রকাশকরা তাদের প্রকাশনা নামক পণ্যকে মানসম্পন্ন করতে বেশি খরচ ও সময় দিতে নারাজ। ফলে বই বের হচ্ছে প্রচুর তবে মানসম্পন্ন বই হচ্ছে খুবই কম।