বেদে ঘরের মেয়ে সুমি ও সোনিয়া। গলায় বিশাল আকারের সাপ পেঁচিয়ে দিনভর শহরে ঘুরে বেড়ান। মানুষকে সাপ দেখিয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা চেয়ে নিয়ে সন্ধ্যার আগে ফিরেন ঝুপড়ি ঘরে। তাদের স্বামী সন্তানদের নিয়ে পথ চেয়ে থাকে উপার্জনক্ষম স্ত্রীর অপেক্ষায়।
শুধু সুমি আর সোনিয়া নয়, বেদে সম্প্রদায়ের বাবু, জাহিদুল, রুবেল এদের প্রত্যেকের স্ত্রীরাই সাপ গলায় পেঁচিয়ে ঘুরে ঘুরে অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দিন শেষে রাতে মানুষ আর সাপ একসঙ্গে বসবাস করে পলিথিনের তৈরি ঝুপড়ি ঘরে।
বগুড়া শহরের সাতমাথায় গলায় সাপ পেঁচিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় কথা হয় সুমির সঙ্গে। তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে রোববার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে মহাস্থন গড় এলাকায় গিয়ে দেখা মেলে সুমির স্বামী নয়ন মিয়ার সঙ্গে।
পলিথিন দিয়ে বানানো অস্থায়ী ঝুপড়ি ঘরে সাপের বাক্স মাথায় দিয়ে বিশ্রাম করছেন তিনি। সাথে দুই সন্তানও রয়েছে। নয়ন মিয়া জানান, সাপের খেলা দেখানো এবং তাবিজ কবজ বিক্রি করাই তাদের মূল পেশা। কিন্তু এখন তাবিজ-কবজে বিশ্বাস কমে গেছে মানুষের। গ্রামাঞ্চলেও লেগেছে শহরের ছোঁয়া। সাপ দেখে এখন মানুষ ভয় করে। ফলে সাপের খেলাও কেউ দেখে না আগের মতো। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে নামিয়েছেন রাস্তায়।
তিনি আরও জানান, পুরুষ মানুষকে কেউ সাহায্য দিতে চায় না। এছাড়া অচেনা অজানা হওয়ায় অন্য কোনো কাজেও তাদেরকে কেউ নিতে চায় না।
মহাস্থান গড়ের পশ্চিমে পরিত্যক্ত জায়গায় বেদে সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস করছে গত একমাস যাবত। প্রত্যেক পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও রয়েছে ৩-৪টি করে সন্তান। এছাড়া রয়েছে ঘরে ঘরে ২-৩টি করে সাপ, তিনটি বানর, একটি পোষা কুকুর। স্ত্রী-সন্তান-সাপ আর বানর নিয়ে ঝুপড়ি ঘরেই রাত্রি যাপন করে এসব বেদে সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। এদের নেই কোনো শৌচাগার, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। এমনকি শিশুদের জন্য নেই কোনো লেখাপড়ার ব্যবস্থা। এদেশের সন্তান হয়েও তারা বঞ্চিত সব ধরনের নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে।
এদেরই একজন জাহিদুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে জানান, সারদিন বানর নিয়ে গ্রামে ঘুরে খেলা দেখান তিনি। এতে করে কিছু চাল এবং নগদ দুই থেকে তিনশ টাকা উপার্জন হয়। সেই উপার্জন দিয়ে সংসারে পাঁচ জন মানুষ ছাড়াও দুইটি সাপ ও বানরকে খাওয়াতে হয়।
তিনি আরও জানান, তাদের থাকার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। এভাবেই তারা ঘুরে বেড়ান এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। ফলে সরকারি সুযোগ সুবিধা কোথায় পাওয় যায় বা যাবে তাও জানেন না তারা। অবহেলিত হয়েই বড় হচ্ছে তাদের সন্তানরাও। কেউ তাদের খোঁজ খবরও নেয় না কখনো।
বেদে সম্প্রদায়ের দলে রয়েছে একজন সর্দার। এই সর্দারই তাদের অভিভাবক। তার নির্দেশনাতেই চলে সব কিছু। সবাই তাকে মেনে চলেন, সম্মান করেন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ থেকে শুরু করে বিয়ে-শাদি মিটানোর দায়িত্ব এই সর্দারের। সর্দারই নির্ধারণ করেন তাদের দল কখন কোন এলাকায় যাবে। আলম সর্দার নামের এই ব্যক্তি নিজেও গ্রামে ঘুরে ঘুরে বানর খেলা দেখিয়ে যা উপার্জন করেন। তাই দিয়েই চলে সংসার।
আলম সর্দার বলেন, ‘নাটোরের সিংড়ায় এক সময় স্থায়ী ঠিকানা থাকলেও এখন আর কিছুই নেই। বেদে দল নিয়ে ঘুরে বেড়াই সারা দেশ।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এদেশের মানুষ আমরা, কিন্তু কেউ খবর রাখে না আমাদের। সরকারি অনেক সুযোগ সুবিধা থাকলেও আমরা কিছুই পাই না ‘
তিনি বলেন, ‘শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরও আমাদের শান্তি নেই, দাফন কাফনেও দুর্ভোগ পোহাতে বেদে পরিবারকে।’
তবে বগুড়া শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে সমাজ সেবা বিভাগের কর্মসূচি রয়েছে। হিজড়া ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের এই কর্মসূচির আওতায় আনা গেলেও বেদেদের এখনো অর্ন্তভুক্ত করা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেদের নির্দিষ্ট ঠিকানা না থাকায় তাদেরকে সব সময় পাওয়া যায় না। এ কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সমাজসেবা অধিদফতর থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করা যায় না।