‘জিন’ শব্দটি নিয়ে আজকাল বিজ্ঞানের জগতে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে। এই ‘জিন’, জ্বীন-পরি-ফেরেশতা নয়, এই ‘জিন’ হলো আমাদের শরীর গড়ার নকশা। বহু ক্ষেত্রে জীবের আচরণও জিনের চরিত্রের দ্বারা নির্ধারিত হয়। জিনের যথেষ্ট ফারাক থেকে দুইটি জীবের ভিন্নতা চিহ্নিত করা সম্ভব।
মানুষের শরীরে মোট জিনের সংখ্যা ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ বলে জীব বিজ্ঞানীদের দাবি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি মানুষ অনন্য। প্রত্যেকের জিন-সমষ্টি আলাদা আলাদা, যদি না তারা সদৃশ জমজ হয়। কিন্তু সেই অমিল মাত্র শূন্য দশমিক ১ ভাগে।
এমন কোনো জিন নেই, যা সাদাদের বা কালোদের মধ্যেই কেবল আছে। চামড়ার রং গুটি কয় জিনের কারসাজি। সাদাদের বা কালোদের মধ্যে সেই জিনগুলো হয়তো সদৃশ। কিন্তু সেসবের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি কম-বেশি হওয়ার কোনোরূপ সম্পর্ক নেই।
একই কথা বলা যায় চোখের রং, উচ্চতা, চুলের কোঁকড়া ভাব, প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে দুধ খেয়ে হজম করার ক্ষমতা, আক্কেল দাঁত উঠার, টাক পড়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি নানা কিছুর পেছনে থাকা জিনের প্রসঙ্গেও।
এমন কোনো জিন নেই, যার দ্বারা কোনো জাতিকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা যায়। কিছু কিছু জিন কোনো কোনো ভৌগোলিক পরিধিতে বেশি মাত্রায় দেখা যায়। এইসব কারণে মানুষের বেলায় ‘জাতি’ শব্দটা জীব বৈজ্ঞানিক পরিধিতে প্রায়-অচল।
কেউ কেউ ‘পূর্বসূরি’ বা ‘অ্যানসেস্ট্রি’ শব্দটি ব্যবহার করেন, জাতি অর্থে নয়। কারণ, একজন মানুষের জিন সমষ্টি নানা ভূগোলের নানা মানব-নদী-প্রবাহের ধারা থেকে বিন্দু বিন্দু বয়ে আসা উপাদানের যোগফল। ‘পূর্বসূরি’ বা ‘অ্যানসেস্ট্রি’ সেই ধারাবাহিকতার ইতিহাস।
ফলে কোথাকার জিন কোথায়, কার মধ্যে গড়িয়েছে, তা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে ধরা পড়ে। যেমন, ২০০৯ সালে দুইজন শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত ও একজন এশীয় নাগরিকের জিন পরীক্ষা করে দেখা গেলো, ইউরোপীয় দুইজনের নিজেদের মধ্যে জিনের যত মিল আছে, তার থেকেও বেশি মিল আছে ওই এশীয়র সঙ্গে!
এ থেকে বোঝা যায়, ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সদৃশ-জিনের সংখ্যা বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক বটে, কিন্তু একই জনগোষ্ঠীর দুইজন মানুষের মধ্যে জিনের পার্থক্যও নাটকীয় রকমের আলাদা হতে পারে।
অতএব, বিজ্ঞানভিত্তিক বিবেচনায় কোনো দিক থেকেই মানুষের মধ্যে কোনো উপবিভাগ বানিয়ে তোলা সম্ভব নয় এবং সে কাজের পেছনে জিনের সাহায্য খোঁজা নিরর্থক। ‘রেস’ বা ‘জাতি’র ধারণাটা কাজেই নিরালম্ব, তা বড় জোর একটি সামাজিক নির্মাণ, জীববিজ্ঞানীদের কাছে যার অবলুপ্তি কাম্য।
মানবিক সাম্যতা ও সমানাধিকারের পক্ষের পণ্ডিতরাও এতে খুশি। কারণ সূক্ষ্মতম বায়োলজিক্যাল দিক থেকেও মানুষ আলাদা বা ছোট-বড় নয়। নানা আর্থ, সামাজিক, পরিবেশ, সুযোগ ইত্যাদি কারণে মানুষের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হলেও মানুষ মূলত জৈবিকভাবে সমান ও পার্থক্যহীন।
মানব-সাম্যের প্রাকৃতিক বিন্যাস সম্পর্কে বিশ্বাস করতে মানুষকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে ও বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়েছে। কাজটি শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে। জোহান গ্রেগর মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪) নামে একজনের মাধ্যমে, যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন ইউরোপের অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যে বর্নো নামক জায়গায়।
জোহান গ্রেগর মেন্ডেলের জন্মস্থান বর্নো নামক জায়গাটি এখন চেক প্রজাতন্ত্রের ভৌগোলিক সীমানাভুক্ত। বার বার যোগ্যতা অর্জনের প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় ফেল করায় চাষি পরিবারের এই সন্তানটির শিক্ষক হওয়ার সাধ অপূর্ণ থাকে। অথচ আপাত ‘অসফল’ মানুষটিই পৃথিবীর বিখ্যাতদের তালিকার একজন। জিন বিষয়ক গবেষণায় অগ্রণীদের অন্যতম রূপে তিনি স্মরণীয়।
প্রাচীন গ্রিসের পণ্ডিত পিথাগোরাস ভেবেছিলেন, বংশগতির ব্যাপারটা পিতৃদত্ত। তার মতে, ‘শুক্রাণু ঘুরে বেড়ায় পুরুষের সারা দেহে। ঘুরে-ঘুরে জোগাড় করে তথ্য বা নির্দেশ’। এমন সব চিন্তা মানুষের বংশগতি বা জিন নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই চলেছে।
১৯০৫ সালে উইলিয়াম বেটসন সর্ব প্রথম ‘জেনেটিক্স’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর এখন তো জিন বিজ্ঞান বা জেনেটিক্সের জয়জয়কার। মানুষের রোগ, শোক, আচার-আচরণ, মিল-অমিল গবেষণায় জেনেটিক্স বা বংশগতি বিদ্যা প্রভূত অগ্রগতি সাধন করে এখন চলেছে ‘জিন’-এর হাত ধরে ‘প্রাণের স্পন্দন’-এর সন্ধানে!